আমরা সকলেই জানি ২০১৭ সালের আগস্ট মাস হতে সংঘাত এবং সহিংসতার ফলে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। দেশ ত্যাগে বাধ্য হওয়া শরণার্থীর সংখ্যা ৭ লক্ষের বেশি। আমরা এও জানি এই শরণার্থীরা সকলে বার্মার আরাকান প্রদেশের বাসিন্দা। বার্মা পরবর্তীকালে মিয়ানমার হয়, আরাকান হয়ে যায় রাখাইন। কথায় বলে যার নাম নাই তার ঠিকানা নাই। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এই নাম পরিবর্তন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশহীন করার বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। সকল স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ আরাকানে ফেলে এই শরণার্থীরা ঠিকানাহীন হতে বাধ্য হয়। কেবল তাদের নির্বাসন যাত্রায় সঙ্গী হয় উদ্বাস্তু হওয়ার দুঃস্বপ্ন, অবর্ণনীয়, অশ্রুত নির্যাতনগাথা। তারই একটি বিবরণ অ্যা ম্যান্ডোলিন ইন এক্সাইল, রফিকুল আনোয়ার রাসেল নির্মিত ৫৬ মিনিটের চলচ্চিত্র, একজন ম্যান্ডোলিন বাদক/গায়ক আহমদ হোসেনের গল্প। ৫৬ মিনিটের ডকুমেন্টারিটির প্রথম সাড়ে তিন মিনিটে মিয়ানমার থেকে শরণার্থীদের আগমনের প্রেক্ষাপট এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতির বিষয়-আশয়ে আলোকপাত করা হয়, যাকে আমরা প্রিলিউড বা ভূমিকা হিসেবে গণ্য করতে পারি। এই ভূমিকাটা মূল গল্পের অংশ না, বরং উপাংশ বলা যেতে পারে।
ভূমিকা শেষ হলে আমরা গল্পের প্রধান চরিত্র আহমদ হোসেনের সাথে পরিচিত হই। পূর্বেই বলেছি আহমদ হোসেন একজন ম্যান্ডোলিন বাদক যিনি দেশ ত্যাগে বাধ্য হওয়া ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একজন। আহমদ হোসেন আরাকানে কৃষি কাজ এবং দিনমজুরি করতেন এবং অবসরে মনের খেয়ালে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে গান গাইতেন। এখন, টেকনাফের মধুছড়া ক্যাম্পেও তিনি ম্যান্ডোলিন বাজান, যদিও তার গানের কথা এবং সুর পাল্টে গেছে। এখন তিনি তার স্বজাতির দুর্দশা নিয়ে গান রচনা করেন এবং ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে গান, এনজিও সমূহের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও সেসব গান গেয়ে থাকেন। তার স্বজাতিকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন তার গানের মাধ্যমে। অন্যদিকে আহমদ হোসেন একজন মুসলিমও বটে। ধর্মের সাথে কি তার ম্যান্ডোলিনের কোন বিরোধ ঘটে? একজায়গায় হোসেন বলেন একজন মানুষ যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন তার প্রাণ না থাকলে যেমন পরিণত হয় ধুলোয় তেমনি সেও ম্যান্ডোলিনবিনা মৃত, ধুলিসমান। ম্যান্ডোলিনটা তার আত্মার মত। তিনি নিজে কোন বিরোধ দেখেন না। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কট্টরপন্থীদের আনাগোনা বিলক্ষণ আছে, বিরোধিতা সরাসরি না হলেও নানা ভাবে হয় বৈকি। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত। কোন ভাবে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পার হওয়া গেলেও উচ্চ শিক্ষায় নানা রকম প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দুনিয়াজুড়ে-ই এই সুযোগটা নিয়ে থাকে, তার ইঙ্গিত ম্যান্ডোলিন ইন এক্সাইলেও আছে।
আমারো দেশখান ফুলেও বাগান/ চাইতে কী সুন্দর লাগেরে…
আহমদ হোসেনও দারিদ্রতার মধ্যেই বড় হয়েছেন। ছোটবেলায় হারান মা-বাবাকে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সুযোগ পাননি। তিনি যে ম্যান্ডোলিন বাজান তাও দেখে দেখে শেখা। কিন্তু তার ম্যান্ডোলিন বাজানোয় যেমন একজন দক্ষ বাদকের ছাপ রয়েছে, তেমনি তার সে ছাপ আছে তার রচিত গানের কথা এবং সুরেও। অবশ্য গানগুলো ঠিক রচিত বলা যায় না, বরং হৃদয় থেকে উৎসরিত বলা-ই ভালো। সবমিলিয়ে আহমদ হোসেন একজন পরিপূর্ণ শিল্পীর প্রতিচ্ছবি, যিনি ফুলের বাগানেরমত তার স্বদেশ আরাকানের কথা আমাদের শোনান।
আহমদ হোসেন বাদেও এই ছবির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রফিক। এই ছবির সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী সিকোয়েন্সটি রফিকের ঘরেই দৃশ্যায়িত হয়েছে, যেখানে এক বৃষ্টিমুখর দিনে রফিকের মা, রফিক এবং আহমদ হোসেনের আলাপচারিতায় উঠে আসে রাখাইনে তাদের উপর মিয়ানমার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় নিপিড়নের মর্মন্তুদ বিবরণ। এটি রোহিঙ্গাদের উপর ঘটা নির্যাতনের প্রতিনিধিত্বশীল বিবরণ নিঃসন্দেহে। পুরো সিকোয়েন্সটিতে কোন রকম আরোপিত বিষয় নেই। বৃষ্টিমুখর একদিনে চা খেতে খেতে খুব ক্যাজুয়াল আলোচনা থেকে অনেকটা হৃদয়খুঁেড় বেদনা জাগানোর মতই গহন সে স্মৃতিচারণ, এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সুনির্মিত সিকোয়েন্স, অন্তত আমার বিবেচনায়।
রোহিঙ্গারা নিজের দেশে ফিরতে চায়না এমন একটি প্রচার কিংবা অপপ্রচার বেশ জোরে-শোরেই প্রচলিত আছে। কিন্তু ছবিটি দেখে আমার মোটেও তা মনে হয়নি। কেউ নিজ ভূমি ছেড়ে ক্যাম্পে বন্দি অবস্থায় নিশ্চয়-ই থাকতে চাইবে না। তাদের দাবীর বিষয়টি খুবই মৌলিক এবং যৌক্তিক। তারা তাদের কেড়ে নেয়া নাগরিকত্ব ফেরত চায়, তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার চায় আর চায় তাদের উপর হওয়া নির্যাতনের বিচার। এই ক’টি অতি যৌক্তিক দাবী পূরণ হলেই রোহিঙ্গারা তাদের দেশ আরাকানে ফিরতে রাজি। প্রজন্ম ধরে বাস করা একটি জনগোষ্ঠীকে কোন রাষ্ট্র চাইলেই রাতারাতি দেশহীন করতে পারে না। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে যে কাজটি করেছে তা বিশ্ব মানবতার জন্য চরম লজ্জাজনক একটি ঘটনা। এবং এটি এও প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক আইন বিষয়টি কাজীর গরু, কিতাবে আছে বটে গোয়ালে নাই।
বিশ্বের বৃহত্তম এবং সর্বাপেক্ষা ঘন বসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবির কুতুপালংয়ের একটি নিবিড় চিত্র আমরা এই ছবিতে আবিষ্কার করি। মক্তব, বাজার, অলস আড্ডা, ত্রাণ, এনজিও কার্যক্রম ইত্যাদির মধ্যে শরণার্থী জীবনের প্রাত্যহিক যাপনের চিত্র পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর আয়োজিত প্রতিযোগিতায় এই প্রজেক্টটি প্রথম স্থান অধিকার করে। এটি পরিচালকের নির্মিত প্রথম ডকুমেন্টারি। রফিকুল আনোয়ার একজন চলচ্চিত্র সংঘটক, শিক্ষক এবং স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হয়। ফলে এই ধরণের চলচ্চিত্র প্রায়শই ঝা-চকচকে এবং টেকনিক্যালি নিখুঁত হয় না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি অর্থায়নে নির্মিত চলচ্চিত্র নানাভাবে সেন্সরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, পরিচালক হয়ত চাইলেও তার সিনেমাটা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তৈরি করতে পারেন না। ম্যান্ডোলিন ইন এক্সাইলও সে ত্রুটিমুক্ত নয়।
কিন্তু সকল সীমাবদ্ধতার পরও অ্যা ম্যান্ডোলিন ইন এক্সাইল একজন আহমদ হোসেনকে আমাদের সামনে হাজির করে। এমন একজন শিল্পী যিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেদনাকে তাঁর ম্যান্ডোলিনে ধারণ করেন, যিনি তার জনগোষ্ঠীর আকুতি এবং আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেন। ফলে আহমদ হোসেনের ম্যান্ডোলিন কেবল একটি সাধারণ ম্যান্ডোলিন থাকে না, হয়ে ওঠে একটি নির্বাসিত জনগোষ্ঠীর বিষাদের রাগিণী, যেখান থেকে অনুরণিত হয় –
‘মার কূলে বসিয়াকান্দি, আমার তো কেউ নাই
মাঝি পার কর রে…’
নাফ নদীর ওপারে সোনার আরাকানে কোন একদিন আহমদ হোসেন এবং তার ম্যান্ডোলিন ফিরে যাবে, আমরা কেবল সে প্রত্যাশাটুকু-ই করতে পারি।