তাগুত-‘তাগা’ নামক আরবী শব্দ থেকে এসেছে। তাগা–র অর্থ হচ্ছে সীমালঙ্ঘনকারী। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে পাকে বলেছেন, ‘ অতঃপর যে ব্যক্তি সীমালঙ্গন করেছে এবং দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, অবশ্যই জাহান্নাম হবে তার আবাসস্থল; যে ব্যক্তি তার মালিকের সামনে দাঁড়ানোর দিনটিকে ভয় করেছে এবং নিজের নফসকে কামনা–বাসনা থেকে বিরত রেখেছে, অবশ্যই জান্নাত হবে তার অনন্ত ঠিকানা’–সূরা আন নাযেয়াত– ৩৭–৪১। আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি প্রথম যে আদেশ করেছেন সেটি হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা এবং সমস্ত তাগুত থেকে বেঁচে থাকা। মহান রাব্বুল আ’লামিন তাঁর সমস্ত নবী–পয়গম্বরদেরকে একটি আদেশই করেছিলেন, ‘আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি, যাতে করে (সেই রাসূল বলতে পারে যে) তোমরা এক আল্লাহতায়ালার ইবাদত কর এবং তাঁর বিরোধী শক্তিসমূহ বর্জন কর’– সূরা আন নাহল– ৩৬। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদত পাওয়ার অধিকার নেই। যদি কেউ সেই নিকৃষ্ট কাজটি করে থাকে, সে তাগুত হিসাবে পরিগণিত হবে। তাগুতের মূল কথাই হচ্ছে: আল্লাহ ছাড়া যে ব্যক্তির ইবাদত করা হয় এবং সে তার ইবাদতে সন্তুষ্ট থাকে, তাকে তাগুত বলা হয়। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর আনুগত্য বাদ দিয়ে যাদের আনুগত্য করা হয় তাদেরকেও তাগুত বলা হয়। তাগুতের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকারভেদ হচ্ছে– ১। ইবলিশ: সে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদতের দিকে মানুষদের আহ্বান করে, ‘হে বনী আদম, আমি তোমাদেরকে এই মর্মে নির্দেশ দিইনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত কর না, সে অবশ্যই তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন’– সূরা ইয়াছিন– ৬০। আল্লাহ ছাড়া যতকিছুর উপাসনা করা হয় এর মূলে রয়েছে ইবলিশ, সেই হচ্ছে সমস্ত শিরকের মূল হোতা। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হয়ে যাও এবং কোনো অবস্থায়ই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না; অবশ্যই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন’– সূরা বাকারা –২০৮। ২। আল্লাহর আইন বিরোধী অত্যাচারী শাসক–যে শাসক আল্লাহর দেয়া বিধান পরিবর্তন করে দেয় এবং মানব রচিত বিধান কিংবা শাসনতন্ত্র কায়েম করে। যেমন: কেউ যদি বলে চোরের শাস্তি হাতকাটা–এটি বর্বরতা, হত্যার শাস্তি কেসাস, জিনার শাস্তি রজম বর্তমান যুগে চলবে না ইত্যাদি। অথচ আল্লাহর ঘোষণা, ‘পুরুষ কিংবা নারী– এদের যে কেউই চুরি করবে, তাদের উভয়ের হাত কেটে ফেলো, এটি তাদেরই কর্মফল, আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি নির্ধারিত দন্ড’– সূরা মায়েদা– ৩৮। এখন আল্লাহর এই বিধানকে কেউ অস্বীকার করে কিংবা এ অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালাতে অনীহা প্রকাশ করে তাহলে সে সরাসরি তাগুত হিসাবে পরিগণিত হবে। আল্লাহতায়ালা অন্য একটি আয়াতে বলেন, ‘হে মানুষ তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের জন্য নরহত্যা (ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে) কেসাস ফরজ করে দেয়া হয়েছে’– সূরা বাকারা– ১৭৮। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী তুমি কি তাদের অবস্থা দেখোনি– যারা মনে করে, তারা সেই বিষয়ের ওপর ঈমান এনেছে যা তোমার কাছে পাঠানো হয়েছে এবং তার ওউপরও ঈমান এনেছে যা তোমার আগে নাযিল করা হয়েছে (কিন্তু বিচার ফয়সালার সময় আমার কিতাবের বদলে) এরা মিথ্যা মাবুদের কাছ থেকে ফয়সালা পেতে চায়, অথচ এদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন এ (মিথ্যা মাবুদ) দের অস্বীকার করে; শয়তান এদের সত্য থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতে চায়’– সূরা আন নিসা– ৬০। ৩। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন (কোরআন সুন্নাহ ভিত্তিক) তা বাদ দিয়ে যে বিচারক/শাসক বা নেতাগণ অন্য আইন/বিধান/সংবিধান দিয়ে ফয়সালা করে। যেমন: কোরআন হাদিস বিরোধী কোন আইন, কিয়াস, কারো ফতোয়া, পীর মাশায়েখদের কথা মানা, আইন পাশ করে সমাজে চাপিয়ে দেওয়া এবং বিজাতিদের মনগড়া সংবিধান মানা। যেমন: আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না, তারাই কাফের’– সূরা মায়েদা– ৪৪। ৪। যে ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী করে সে তাগুত। এদের মাঝে রয়েছে জ্যোতিষী, গণক, রাশিচক্র ইত্যাদি। যেমন: আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এগুলো তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা আছে একমাত্র তিনিই জানেন। কোন্ পাতা ঝরে না কিন্তু তিনি জানেন। কোনো শস্য কণা, মৃত্তিকা অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোনো আদ্র ও শুষ্ক দ্রব্য পতিত হয় না কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে রয়েছে’– সূরা আনআম–৫৯। ৫। আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত/পূজা উপাসনা করা হয় এবং এতে যে রাজি/খুশি থাকে সে তাগুত। এদের মাঝে রয়েছে সেইন্ট, ঠাকুর, পীর ফকির, ধর্মীয় গুরু, নেতা ইত্যাদি যাদেরকে পূজা করা হয়। যেমন: আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের মধ্যে যে বলে যে, তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত আমি উপাস্য, তাকে আমি জাহান্নামের শাস্তি দিব। আমি জালেমদেরকে এভাবে প্রতিফল দিয়ে থাকি’– সূরা আল আম্বিয়া– ২৯। আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসাবে আল্লাহর ফরজ বিধানগুলো আমরা মেনে চলি যেমন: নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি। অথচ এই কোরআন দিয়েই নামাজ পড়া হয়, সেখানেই আল্লাহর বিধান বিরোধী সমাজ ব্যবস্থা চালুর বিরুদ্ধে অনেক আয়াত রয়েছে সেটা আমরা কর্ণকুহুরে শুনি এবং তা সবিনয়ে মেনে নিই। কিন্তু মসজিদ থেকে বের হয়ে সেই বিধানের বিপক্ষে যারা আন্দোলন সংগ্রাম করে, মানব রচিত মতবাদ দিয়ে বিচারকাজ, শাসনযজ্ঞ পরিচালনা করে–তাদের বিভিন্ন সভা সমাবেশে যোগ দিই, তাদের কার্যক্রমে সম্মতি জানাই, তাদের গড়া আইন অনুযায়ী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হই, সংসদে প্রতিনিধিত্ব করি, মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হই অথচ আমরা সবাই যে তাগুত হয়ে বসে আছি সেই খেয়াল আমাদের মধ্যে নেই। এদেরকে যারা অনুসরণ করবে তারাও সবাই তাগুত। তাগুত কাফেরদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কারণ কাফের আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে কিন্তু অন্যকে সে মতবাদ চাপিয়ে দেয় না। কিন্তু তাগুত নিজেও করবে না এবং অন্যকেও তা করতে বাধা সৃষ্টি করে। অথচ আল্লাহ তায়ালার প্রকাশ্য ঘোষণা: ‘কোনো ব্যক্তি যদি বাতিল মতাদর্শকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে যেন এর মাধ্যমে এমন এক শক্তিশালী রশি ধরলো, যা কোনদিনও ছিড়ে যাওয়ার নয়’– সূরা বাকারা– ২৫৬। অপরদিকে আপনার স্ত্রীও তাগুত হতে পারে যেমন: ফজরের সালাত আদায় করার জন্য আপনি উঠেছেন কিন্তু আপনার স্ত্রী এতে বাধা দিচ্ছে। বাহিরে ঝড় বৃষ্টি, অন্ধকার, ছিনতাইকারীর ভয় কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে ফজরের সালাত আদায় করতে যাচ্ছেন–এতে বাধা হয়ে পড়ে আপনার স্ত্রী। এক্ষেত্রে আপনার স্ত্রীও তাগুত। আপনার ছেলে দাঁড়ি রেখেছে, এতে মা–বাবা অসুন্তুষ্ট–অল্প বয়সে দাঁড়ি রাখা কেমন যেন বেমানান। এক্ষেত্রে আপনার পিতা–মাতাও তাগুত কারণ এটি রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাত। এই সুন্নাতকে আপনি অস্বীকার করছেন। পানি যেমন সীমালঙ্গন করে তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও সীমালঙ্গন হতে পারে। যারাই সেই নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করবে, আল্লাহর দেওয়া বিধানকে সরাসরি অস্বীকার করবে তারাই একযোগে তাগুত। এদেশে ১৯৮৮, ১৯৯১,১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে পানি সীমালঙ্গন করেছে। যে পানি সীমালঙ্গন করে হযরত নূহ (আঃ) এর জাতিকে ডুবিয়ে দিয়েছিল, যে পানি ফেরাউনকে তার দলবলসহ সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিল, যে পানি এই বাংলার জমিনকে বারবার ভাসিয়ে দিয়েছিল–সেই পানি এখনও আছে, সে আকাশওয়ালা মহাশক্তিধর আল্লাহতায়ালা এখনো আছেন, সে পানির মতন সীমা অতিক্রম করলে আল্লাহর আইন বিরোধী তাগুত বান্দারাও এভাবেই পানির তোড়ে ভেসে যাবে দূর তেপান্তরে। যদি আল্লাহর কোরআন বিরোধী আইনুযায়ী এদেশে আইন প্রবর্তন বর্তমান থাকে, সেই আইন গণমানুষকে মানার জন্য বাধ্য করা হয়, তাহলে কঠিন শাস্তি লিপিবদ্ধ রয়েছে কোরআনের প্রতিটি পাতায় পাতায়। সে সমস্ত ব্রিটিশ আইনের পক্ষে পৃথিবীতে থাকা বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর কপালে জুটতে পারে অচিরেই। আসুন সেই তাগুত শক্তিকে বর্জন করি। আল্লাহকে একমাত্র আইনপ্রণেতা, শেষ দিনের মহাবিচারক হিসাবেই মেনে নেই এবং নিজের জীবনকে বর্ণিলভাবে সাজাই।
লেখক : সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল