আর কত সাদিয়া এভাবেই চলে যাবে

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | রবিবার , ১০ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল সম্প্রতি নগরীর বাদামতলী এলাকায়। আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়া আগ্রাবাদে শাহ্‌জালাল চশমা মার্কেটে চশমা কিনে বাসায় ফেরার পথে বাদামতলী মাজার গেইটের সামনে প্রাইম ব্যাংকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাত ১০টার দিকে পা পিছলে খোলা নালায় পড়ে যান। আর এতেই জীবনের জন্য হারিয়ে যান সাদিয়া। আর কোনদিন সাদিয়া ফিরে আসবে না এই দুনিয়ার জীবনে। জাগতিক জীবনে অনেকগুলো স্বপ্ন নিয়ে বুনতে থাকা মেধাবী ছাত্রী লাশ হয়ে ফিরলেন তার মা বাবার কাছে এর চেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা আর কি হতে পারে? মা-বাবার স্বপ্ন ছিল সাদিয়া উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে। মনের মাঝে জমে থাকা স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হবে কিন্তু সেই আশা অকালেই ঝরে গেল। আইআইইউসি কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী সাদিয়া আর কোনদিন আসবে না তার সহপাঠীদের কাছে। অকালে ঝরে পড়া সাদিয়াকে কবরে সমাহিত করার মাধ্যমেই শুরু হয়ে গেল তার কিয়ামতের প্রথম ধাপ। আমরা সাদিয়ার জন্য প্রাণভরে দোয়া করব- তার কবরের হিসাব যেন সহজ হয়ে যায়। জিন্দেগীর সমস্ত গুনাহ আল্লাহতায়ালা যেন মাফ করে দেন। তার এই অকাল মৃত্যু যেন নাযাতের উছিলা হয় সেই কঠোর বিচার দিবসে। এটি নতুন কোন ঘটনা নয়, এর আগেও আরো চারজন এভাবেই খোলা নালায় পড়ে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে। গত ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে নালায় পড়ে নিখোঁজ হওয়া ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদের কোন হদিস অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসমূহ যেন শীতনিদ্রায় আছেন। সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএ’র মধ্যকার কর্তৃত্বের টানাপোড়ন নিয়ে চলছে প্রহসন, আর এই প্রহসন কতদিন চলবে? তাদের দ্বন্দ্বে বলি হতে হচ্ছে নিরীহ পথচারীদের। সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, খোলা নালা ও খালে স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নগরবাসী এখনো দেখেনি। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এম মঞ্জুর আলম ট্রাকভর্তি স্ল্যাব নিয়ে বর্তমান মেয়রের কাছে হাজির হলেন। এর পরেও যেন টনক নড়েনি প্রশাসনের। এভাবে আর কত সাদিয়া আর সালেহ আহমেদের জীবনহানি হবে তা কেউ জানে না। নগরীর অনেকগুলো খাল এবং নালা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে বৃষ্টির সময় এগুলো যেন একাকার হয়ে যায়। এর আগে ৩০ জুন নগরীর চশমা খালে যাত্রী বোঝাই সিএনজি ট্যাক্সি পড়ে দুইজন নিহত হয়। এর আগেও মোহাম্মদ আলী রোডেও নালায় পড়ে মারা গিয়েছেন একজন। গত বছরেও হালিশহর ইসলামিয়া ব্রীক ফিল্ড এলাকায় মহেশখালে পড়ে দুই কিশোরীর মৃত্যু হয়। এভাবে একের পর এক তরতাজা প্রাণগুলো নালায় পড়ে ভেসে যাচ্ছে অনির্দিষ্ট ঠিকানায়। এতসব করুণ ঘটনা ঘটার পরেও প্রশাসন যেন বেখবর। নগরীর নালাগুলো যেন এক একটি ভয়াল মৃত্যুকূপ। এগুলো বড়ই আতংকের। এগুলোর কাছে গেলে যেন গা শিউরে উঠে। আর বৃষ্টির সময় তো কোন কথাই নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই পুরো চট্টগ্রাম নগরী ছোটখাটো সমুদ্র হয়ে যায়। আর এর উপরে ভাসমান আতংকিত ভয়ার্ত নগরবাসী। কখন কার কপালে কি জোটে এই আতংকে। এতগুলো প্রাণ সংহারের পরেও অদ্যাবধি খোলা নালাগুলোর উপর স্ল্যাব বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আর কত প্রাণ যাবে এই তল্লাটে? সে প্রশ্নই এখন সবার মুখে মুখে। সাদিয়ার মত মেধাবি ছাত্রী আর কোনদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু অন্য সাদিয়াদের জীবনতো বাঁচাতে হবে। আর সেই লক্ষ্যেই এগুতে হবে অতিশীঘ্রই নগরপিতাকে। আমরা আকুল আবেদন জানাবো, দ্রুত যেন উন্মুক্ত নালাগুলোতে স্ল্যাব বসানোর কাজটা শুরু হয়। একটা মৃত্যুর পর অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসে। কিন্তু হায় নিয়তির পরিহাস, সে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার যেন কেউ নেই। নগরের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। এর কিছুদিন পরে সব তিথিয়ে যায়। রাজনৈতিক নেতাদের মতবিরোধ, সেবা সংস্থাগুলোর মাঝে রশি টানাটানি সাদিয়ার মত অনেক মৃত্যুকে জানান দিয়ে যায়। আকাশে মেঘ দেখলেই নগরবাসীর মাঝে ভয়ের রেশ শুরু হয়ে যায়। এইতো শুরু হবে বৃষ্টি। আর তলিয়ে যাবে নগরীর রাজপথ, খাল ও নালা। সব একাকার হয়ে থুবড়ে পড়বে নগরবাসী। প্রকল্প আসে আর যায়- উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যায় পুরো নগর। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ভোগান্তি বাড়ে নগরবাসীর। ফ্লাইওভার করে লাভ কি? এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করে লাভ কি? যদি নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়। উপরে ফুটওভার ব্রীজ আর নিচে মৃত্যুকূপ- এই প্রহসনের মানে কি? নগরবাসী এই বঞ্চনা আর প্রহসন মেনে নেবে না। আমরা চাই সমন্বিত পদক্ষেপ, পারস্পরিক সমাঝোতার মাধ্যমে উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ। যেই সিদ্ধান্তের আলোকে সাজানো হবে সুন্দর নগরী। আত্মম্ভরিতা আর অহংকারের কবলে পড়ে নগরবাসীকে ঠকানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এর শেষ কোথায় আশায় দিন গুণছি। পাদটিকা : গত ০২ অক্টোবর আজাদীতে প্রকাশিত ‘একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু আর তার চুলচেরা বিশ্লেষণ’ নিবন্ধে কোনো ব্যক্তি বা মহলকে কটাক্ষ করা হয়নি। এর পরেও রাফসানের পরিবার বা কেউ যদি এতে মর্মাহত হয়ে থাকেন, আমি দুঃখিত।
লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবচেতন ভালোবাসায় হরিণ বাস
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে