চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় এবার মহানগরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের তুলনায় ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম পাস করেছে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার শিক্ষার্থীরা। এর আগে গত বছর (২০২৩) এ ব্যবধান ছিল ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ ফলাফলের দিক দিয়ে নগরের চেয়ে মফস্বলের শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে থাকার ব্যবধান কমছে। এছাড়া এবার মহানগর ও মফস্বল দুটোতেই পাসের হার বেড়েছে। তবে গতবারের তুলনায় পাসের হার বৃদ্ধিতে এগিয়ে আছে মফস্বল।
পাশাপাশি বোর্ডে শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুলের তালিকায়ও এগিয়ে আছে মফস্বল। তবে জিপিএ–৫ এর ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় পিছিয়ে আছে মফস্বল। জিপিএ–৫ এর ভিত্তিতে গতবার সেরা ১০ স্কুলের তালিকায় মফস্বলের স্কুল থাকলেও এবার একটিও নেই। অবশ্য মহানগরের চেয়ে সুযোগ–সুবিধা কম থাকা তিন পার্বত্য জেলা এবার ফলাফলে এগিয়েছে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে চট্টগ্রাম বোর্ডে এগিয়েছে মফস্বল। চট্টগ্রাম বোর্ডে এবারসহ গত চার বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যবধান কমলেও বোর্ডের সামগ্রিক ফলাফলে পিছিয়ে আছে মফস্বল। সরকারের নানা উদ্যোগ ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধির পরও মফস্বলের শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে থাকা নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা। এক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যমান বা নিত্যনতুন সুযোগ–সুবিধাগুলোর বেশিরভাগ নগরকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে করা হয় কিনা সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিতে সার্বিকভাবে পরীক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। তিনি বলেন, পাহাড়ের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা এগিয়ে গেছে। এটা একটা ভালো দিক। এর কারণ হিসেবে আমরা যেটা ধারণা করছি, কোভিড মহামারিকাল কাটিয়ে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এখন যে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দূরত্ব ও দুর্গম এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনায় পাহাড়ে সাধারণত পরীক্ষাকেন্দ্র পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রে যে স্কুলের শিক্ষার্থী, সে স্কুলেই তার পরীক্ষাকেন্দ্র হয়। পরিবেশেরও একটা ইতিবাচক প্রভাব আছে।
পাসের হার বিশ্লেষণ : এবার (২০২৪) চট্টগ্রাম মহানগরে পাসের হার ৮৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৮৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে এবার নগরে পাসের হার বেড়েছে ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এবার মহানগর বাদে জেলায় পাসের হার ৮৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে ছিল ৭৮ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় এবার মফস্বলে পাসের হার বেড়েছে ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
নগর ও মফস্বলের এ পাসের হার বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার মহানগর ও মফস্বল দুটোতেই পাসের হার বেড়েছে। তবে গতবারের তুলনায় পাসের হার বৃদ্ধিতে এগিয়ে আছে মফস্বল।
এছাড়া গত কয়েক বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২২ সালে মহানগরে পাসের হার ছিল ৯৪ দশমিক ২১ শতাংশ। একই বছর মহানগর বাদে শুধু জেলায় পাসের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ সে বছর মফস্বলের চেয়ে নগরে পাসের হার ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি ছিল।
এর আগে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম মহানগরে পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। একই বছর জেলায় পাসের হার ছিল ৯১ দশমিক ০১ শতাংশ। অর্থাৎ পাসের হারে ২০২১ সালে মফস্বলের চেয়ে ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ এগিয়ে ছিল নগর। এর আগে ২০২০ সালে নগরের বাইরের স্কুলগুলোতে পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। একই বছর নগরে পাসের হার ছিল ৯০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২০ সালে মফস্বলের চেয়ে নগরের পাসের ৫ দশমিক ২ শতাংশ বেশি ছিল।
জিপিএ–৫ : চট্টগ্রাম বোর্ডে জিপিএ–৫ এর দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা ৩৫টি স্কুলের তালিকায় পিছিয়ে আছে মফস্বল। এ তালিকার ২৩টিই নগরের, মাত্র ১২টি মফস্বলের। এছাড়া জিপিএ–৫ এর ভিত্তিতে সেরা ১০টি স্কুলের তালিকায় নেই মফস্বলের একটি স্কুলও। অবশ্য গতবার জিপিএ–৫ এর ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত সেরা ১০ স্কুলের একটি ছিল মফস্বলের।
শতভাগ পাস করা স্কুল মফস্বলে বেশি : চট্টগ্রাম বোর্ডে এবার শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুলের সংখ্যা ৪৬টি। এর মধ্যে মফস্বল এলাকায় অবস্থিত স্কুল আছে ২৫টি। বাকি ২১টির অবস্থান নগরের। অর্থাৎ শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুলের সংখ্যা মফস্বলেই বেশি। গত বছর শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুলের সংখ্যা ছিল ৪৫টি। এর মধ্যে মফস্বল এলাকায় অবস্থিত স্কুল ছিল ২৫টি। বাকি ২০টির অবস্থান নগরের। এর আগে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বোর্ডে শতভাগ পাস করে ৭১টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে মফস্বল এলাকায় অবস্থিত স্কুল ছিল ৪০টি। অর্থাৎ এবারসহ টানা তিনবার শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুলের তালিকায় এগিয়ে আছে মফস্বল।
এগিয়েছে তিন পার্বত্য জেলা : চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীন পাঁচটি জেলার (চট্টগ্রাম, কঙবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গত বছর এই পাঁচ জেলার মধ্যে তিন পার্বত্য জেলার ফলাফল পিছিয়ে ছিল। গতকাল প্রকাশিত ফলাফলেও দেখা গেছে একই চিত্র। অর্থাৎ এবারও বোর্ডের মধ্যে ফলাফলে পিছিয়ে আছে তিন পার্বত্য জেলা। তবে এবার এ তিন জেলায় গতবারের চেয়ে পাসের হার বেড়েছে। এ বৃদ্ধির হারও বিগত সময়ের তুলনায় ‘সন্তোষজনক’ বলছেন বোর্ড সংশ্লিষ্টরা। কারণ গতবার পূর্বের বছরের (২০২২) তুলনায় পাসের হার কমেছিল তিন জেলাতেই। বিপরীতে তিন জেলাতে এবার পাসের হার বেড়েছে গতবারের তুলনায়। এর মধ্যে বোর্ডের আওতাধীন পাঁচ জেলার মধ্যে এবার পাসের হার বৃদ্ধির দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে রাঙামাটি।
চট্টগ্রাম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এবার বোর্ডের ফলাফলে পিছিয়ে আছে খাগড়াছড়ি জেলা। এ জেলায় পাসের হার ৭২ দশমিক ২৫ শতাংশ; যা ২০২৩ সালে ৬৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০২২ সালে ৭৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৮৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অথচ গত বছর তার পূর্বের বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
গত বছর তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে পাসের হারে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল রাঙামাটি। এবার পাসের হারে সবচেয়ে এগিয়ে আছে জেলাটি। এবার পাসের হার ৭২ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৬৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালে ৮১ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৮৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ এবার রাঙামাটিতে পাসের হার গতবারের চেয়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। অথচ গতবার তার পূর্বের বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছিল ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এবার বান্দরবান জেলায়ও পাসের হার ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ; যা গতবার ছিল ৭০ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালে ছিল ৭৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৯০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ এবার পাসের হার বেড়েছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ গতবার তার পূর্বের বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছিল ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।
তিন পার্বত্য জেলার বাইরে পাসের হারে এগিয়েছে কঙবাজারও। এ জেলায় এবার পাসের হার ৮৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে ৭৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এ হার ছিল ৯০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ কঙবাজারে এবার পাসের হার বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এছাড়া এবার চট্টগ্রাম জেলায় পাসের হার ৮৪ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ছিল ৮৯ দশমিক ১১ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ চট্টগ্রাম জেলায় এবার পাসের হার বেড়েছে ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ।