চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরে অনুদান খাতে সরকারি ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ৯৮৩ কোটি টাকা ৫ লাখ পেয়েছে। যদিও অর্থ বছরটিতে অনুদান খাতে চসিকের আয়ের প্রত্যাশা ছিল ৮৯৪ কোটি টাকা। যা প্রত্যাশার চেয়ে ৮৯ কোটি ৫ লাখ টাকা বেশি। একই অর্থবছরে পৌরকরসহ নিজস্ব উৎস থেকে চসিকের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫০ কোটি টাকা ৫৮ লাখ টাকা। বিপরীতে আয় হয়েছে ৬৩৯ কোটি ৫৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ নিজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার ৩২ শতাংশ পূরণ হয়নি।
তথ্য দুটো পাশাপাশি রাখলে স্পষ্ট চসিকের আয় মূলত অনুদান নির্ভর। সংস্থাটির ২০১৭–২০১৮ অর্থবছর থেকে পরবর্তী প্রতিটি বাজেট প্রস্তাবিত আয়ের বিপরীতে সর্বোচ্চ অর্জন ছিল অনুদান। চসিকের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে এ অনুদান দিয়েছে সরকার। এরপরও আগামী ২০২৪–২০২৫
অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে চসিকের সর্বোচ্চ ৫১ শতাংশ আয় ধরা হয় নিজস্ব উৎসে! যা টাকার অংকে ১ হাজার ২৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বিপরীতে অনুদান খাতে আয় ধরা হয় ৯০৯ কোটি টাকা।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে অতীতে অনুদান নির্ভর হলেও বাজেটে নিজস্ব উৎসের আয়কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে কেন? নগরবাসী বলছেন, চসিকের উন্নয়ন অনুদান হিসেবে যে আয় তা প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেয় সরকার। তাই চসিকের উচিত নগর উন্নয়নে আরো বেশি কার্যকর প্রকল্প নেয়া।
গতকাল বৃহস্পতিবার সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেন। যার আকার ১ হাজার ৯৮১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এ বাজেটে নিজস্ব উৎসকে প্রাধান্য দেয়ায় ‘চাপ’ বাড়তে পারে পৌরকরে। কারণ প্রস্তাবিত এ বাজেটে গতবারের (২০২৩–২০২৪) চেয়ে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বেশি পৌরকর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গতবার পৌরকর খাতে চসিকের আয় হয় ২৬১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে তা বৃদ্ধি করে ৪৭১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য বাজেটে গৃহকরের ‘চাপ’র মধ্যেও নগর উন্নয়নে আনুমানিক ৬ হাজার ৭০১ কোটি টাকার ৯টি প্রকল্প পাইপলাইনে থাকার সুসংবাদ দেন মেয়র।
আয় বেশি অনুদানে, তবু নিজস্ব উৎস্য প্রাধান্য :
২০১৭–২০১৮ অর্থবছরে চসিকের উন্নয়ন অনুদান খাতে আয় হয় ৩৯৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। বিপরীতে একই অর্থবছরে নিজস্ব উৎসে আয় হয় ৩৪৩ কোটি ৯৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। পরবর্তীতে ২০১৮–২০১৯ অর্থবছরে উন্নয়ন অনুদান ১ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৮ লাখ ১৪০ হাজার টাকা এবং নিজস্ব উৎসে আয় হয় ৪৪৮কোটি ৭৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। ২০১৯–২০২০ অর্থবছরে উন্নয়ন অনুদান খাতে ১ হাজার ১৯ কোটি ৬৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা এবং নিজস্ব উৎসে আয় হয় ৩৮৮ কোটি ৯০ লাখ ৯ হাজার টাকা। ২০২০–২০২১ অর্থবছরে উন্নয়ন অনুদান খাতে ৫২৯ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং নিজস্ব উৎসে আয় হয় ৪৩৮ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। ২০২১–২০২২ অর্থবছরে উন্নয়ন অনুদান খাতে ৬৮৯ কোটি টাকা এবং নিজস্ব উৎসে আয় হয় ৪৭৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩ লক্ষ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন রেজাউল করিম চৌধুরী। ২০২১ সালের ২৭ জুন তিনি নিজ মেয়াদের প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন। ২০২১–২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত ওই বাজেট ছিল অনুদান নির্ভর। এতে সর্বোচ্চ ৬৪ শতাংশ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে অনুদান ও ত্রাণ সাহায্য খাতে। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭০ কোটি টাকা উন্নয়ন অনুদান এবং চার কোটি টাকা ত্রাণ সাহায্য খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
২০২২ সালের ২৬ জুন নিজ মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেট ঘোষণা করেন রেজাউল করিম চৌধুরী। ২০২২–২০২৩ অর্থবছরের ওই বাজেটও ছিল অনুদান নির্ভর। এতে সর্বোচ্চ ৫৬ দশমিক ৩০ শতাংশ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় অনুদান ও ত্রাণ সাহায্য খাতে। এর মধ্যে এক হাজার ২১২ কোটি টাকা উন্নয়ন অনুদান এবং পাঁচ কোটি টাকা ত্রাণ সাহায্য খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
পর পর দুটি বাজেট অনুদান নির্ভর হওয়ায় নির্বাচনী ইশতেহার ও সভা–সমাবেশ এমনকি বাজেট বক্তব্যেও সিটি কর্পোরেশনকে স্বাবলম্বী করার যে কথা বলেন তার প্রতিফলন না ঘটায় ‘হতাশ’ হন নগরবাসী। এরপর ২০২৩ সালের ২১ জুন ঘোষিত তৃতীয় বাজেটে অনুদান নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে নিজস্ব উৎস থেকে সর্বোচ্চ ৯৫০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা আয় ধরা হয়। কিন্তু এবারও সর্বোচ্চ আয় এসেছে সরকারি অনুদান থেকে। এরপরও চতুর্থ বাজেটে নিজস্ব উৎসের আয়কে প্রাধান্য দেন মেয়র।
বাজেট বাস্তবায়নের হার বেড়েছে :
গতকাল ২০২৩–২৪ অর্থবছরের ১ হাজার ৬৬১ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকার সংশোধিত বাজেট ঘোষণা করেন মেয়র। ওই অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ১ হাজার ৮৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নের হার ৮৮ শতাংশ। সামপ্রতিক সময়ের এ হার সবচেয়ে বেশি। এর আগে ২০২২–২৩ বছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৫৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। তারও আগে ২০১৮–২০১৯ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৮৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। যা টাকার অংকে ছিল ২ হাজার ৪৫ কোটি ৫১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের হার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘কর্মকর্তা ও কাউন্সিলরদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার কারণে সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।’
পাইপলাইনে ৯ প্রকল্প :
পাইপলাইনে রয়েছে এমন ৯টি প্রকল্পের কথা জানান মেয়র। প্রকল্পগুলো হচ্ছে– ২০৩ কোটি টাকায় নগর ভবন নির্মাণ, ২৯৮ কোটি টাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আধুনিক যান ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্প, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন–এর উন্মুক্ত স্থানসমূহ আধুনিকায়ন, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় উন্নয়ন ও সবুজায়ন প্রকল্প, ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় সাতটি রাস্তার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, ২৫০ কোটি টাকায় কিচেন মার্কেট কাম বাণিজ্যিক ভবননির্মাণ প্রকল্প, ৪৫০ কোটি টাকায় ওয়ার্ড কার্যালয় নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন, ২ হাজার কোটি টাকায় ওশান অ্যামিউজমেন্ট পার্কনির্মাণ প্রকল্প, ৭০০ কোটি টাকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্প। এছাড়া আন্তঃজেলা বাস– ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানান মেয়র।