১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের বাসায় আমার বড় ভাই ৭১ শহীদ প্রকৌশলী নুর হোসেন এর একটি মার্ফি রেডিও এলো। ঐ সময় দাদা চাকুরী করতেন নির্মিয় মান কাপতাই হাই ড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টে। তাই রেডিওটা ছিল আমার দখলে তবে বাবার ভয়ে শুনতে হত নিয়ন্ত্রিত শব্দে। বেশির ভাগ শোনা হত আকাশ বানী কলকাতা সেই সময় আমি চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাই স্কুলের ছাত্র এবং স্কুলের কোন সীমানা দেয়াল ছিল না। স্কুলের পশ্চিমপার্শ্বে পাহাড়ের ঢালুতে নামতেই ছিল ছোট্ট একটি বুক স্টল নাম ‘স্ক্রীন এন্ড কালচার’।
টিফিন পিরিয়ড বা স্কুল ছুটির পর মাঝেমধ্যে সেখানে যেতাম, একদিন ওখানে আবিস্কার করলাম ‘বেতার জগৎ’ নামে পত্রিকা যাতে থাকত আকাশ বাণীর নামিদামী শিল্পীদের ছবি এবং নিয়মিত অনুষ্ঠান সূচি শুরু হল স্ক্রীন এন্ড কালচারে নিয়মিত যাতায়াত এবং বেতার জগৎ ক্রয়। নিয়মিত যাতায়াতের কারণে পরিচিত হলাম বুক স্টলের মালিক মোহাম্মদ আমিন সাহেবের সাথে। তিনি আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। এবং বেতার জগতের একটি কপি নিয়মিত আমার জন্য আলাদা করে রাখতেন।
জানলাম ১৯৫১ সালে তৎকালীন বরিশালের ঝালকাঠি থেকে এসে পাহাড়ের ঢালুতে ছড়ার উপরে তিনি এই বুক স্টল ভাড়া নিয়ে শুরু করেন। দোকানের নাম রাখেন “স্ক্রীন এন্ড কালচার” এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের বইগুলি পাওয়া যেত। এখান থেকে ক্রয় করা বেতার জগৎ সহ ‘উল্টরথ’ ‘সচিত্র সন্ধানী’ ‘জলসা’ ইত্যাদি এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। আর এই বইগুলোর মাঝেই আমার স্মরণে আসেন প্রিয় আমিন চাচা। যাই হোক সেই মার্ফি রেডিও এবং বেতার জগতের মাধ্যমে আমি আকাশ বাণীর অধিকাংশ অনুষ্ঠানের শ্রোতা এবং ভক্ত হয়ে গেলাম। ভাল লাগত গান পঙ্কজ মল্লিকের সংগীত শিক্ষার আসর, ইন্দরাদির ছোটদের অনুষ্ঠান অনুরোধের আসর, কাজী সব্যসাচী, অমিয় চট্টোপাধ্যায়, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ প্রমুখের ঘোষণা।
১৯৬২ সালে শহরের উন্নয়নের কারনে স্ক্রীন এন্ড কালচার স্থানান্তরিত হল সি.ডি.এ বিল্ডিং এর নিচ তলায়। নাম হল সিডিএ বুক হাউজ। ১৯৬৭ সালে আরো বড় আকারে এটি আবার স্থানান্তরিত হল জুবিলী রোডের জলসা সিনেমার নিচ তলায় কারেন্ট বুক সেন্টার নামে দীর্ঘদিন এখানে চমৎকার ভাবে বই প্রেমীদের আনাঘোনা থাকলেও পরবর্তীতে যানজট ফুটপাতে হকারদের উৎপাত, দখল ইত্যাদির কারণে ক্রেতাদের পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে সংস্কৃতি প্রেমীদের সাথে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে কারেন্ট বুক সেন্টার আবার স্থানান্তরিত হলো কাজির দেউরীর ভিআইপি টাওয়ার মার্কেটের দোতলায়। অন্যদিকে ১৯৮৮ সালে মোহাম্মদ আমিন সাহেবের একই নামে আরও একটি বুক স্টল উদ্বোধন করেন মিমি সুপার মার্কেটে। একই বছর ৩০শে নভেম্বর জনাব মোহাম্মদ আমিন পরোলোক গমন করেন। এর পর তার বড় ছেলে মোহাম্মদ মুবিন এবং মেজ ছেলে মোহাম্মদ শাহীন। দুই বুক স্টলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বুক স্টলের সাথে আমাদের যোগাযোগ নিয়মিত ছিল এবং এখনো আছে। তবে আমি চলে যাওয়া এই নির্লোভ সাদাসিদে এই মানুষটি অর্থাৎ মরহুম মোহাম্মদ আমিন সাহেবের শূন্যতা ভীষণ ভাবে অনুভব করি।
কারেন্ট বুক সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা জনপ্রিয় মোহাম্মদ আমিন সাহেবকে স্মরণ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক গুণীজনের লেখায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে তার কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন “প্রবীণ এবং নবীনের সম্পর্ক সৃষ্টিতে তার উৎসাহের অন্ত ছিল না। সাহিত্য সৃষ্টিতে এক প্রজন্মে ধারণাকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত করা যে কতটা প্রয়োজন তার যথার্থ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি”। “মানুষের আত্মভোলা মন খুব সহজে অতীতকে ভুলে যায়- কিন্তুু কিছু কিছু লোককে তাঁদের কীর্ত্তির জন্য সহজে ভোলা যায় না। (গ্রন্থ লোকের কারবারী ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৪, দৈনিক আজাদী)।
প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম সিদ্দিক আহমেদ তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছিলেন “বই হোক নিত্য সঙ্গী” এই সীলমোহরটি কোন বইতে পাওয়া গেলে ধরে নেয়া যেত যে বইটি কারেন্ট বুক সেন্টার থেকে নেওয়া। এমনতর স্লোগান কিংবা আহ্বান জানিয়ে বইতে সীল মারার ধারা বাংলাদেশে বলতে গেলে কারেন্ট বুক সেন্টার চালু করে।”
২৮-১২-১৯৯০ তারিখে দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় বেগম মুশতারী শফি লিখেছেন- “মৃত্যুর কিছুদিন আগে রেডিও অফিসে উপ-পরিচালক শামসুল হুদা চৌধুরীর কক্ষে তাঁর সাথে আমার দেখা। এসেছিলেন বোধ করি তাঁর ছোট মেয়ে রাশেদা বেগমের রেকর্ডিংয়ে। কথা প্রসঙ্গে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম এত ব্যবসা থাকতে আপনি এই ব্যবসায় এলেন কেন আমিন ভাই?” আমার এই প্রশ্নে তার মুখ কি এক আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন “আপা একটি দেশ এঙপোর্ট ইনপোর্ট ব্যবসা আর ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে তোলার মাধ্যমে বিত্তে সমৃদ্ধ হতে পারে। কিন্তু জাতীয় গৌরব অর্জিত হয় শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলে। তার নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক ইতিহাস ঐতিহ্যর বিস্তার ঘটানোর মধ্য দিয়ে। আর এই বিরাট কাজটির একটি অংশ হচ্ছে গ্রন্থ রচনা প্রকাশ ও পাঠক সৃষ্টি করা।”
আজ ৩০শে নভেম্বর, ২০২১ মোহাম্মদ আমীন সাহেবের তেত্রিশতম মৃত্যুদিবস। আমি তার রুহের শান্তির মাগফেরাত কামনা করি। আরও দীর্ঘসময় ধরে এই চাটগাঁর বুকে তার প্রতিষ্ঠিত কারেন্ট বুক সেন্টার পাঠকের মাঝে বেঁচে থাক।
লেখক : সাবেক মুখ্য উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার।