চেন্নাই শহরে শ্রীলংকার এক তামিলের খোঁজ পেয়েছিলাম। আলাপ জুড়তেই সে শ্রীলংকার তামিল পরিচয় অস্বীকার করল। বুঝলাম, সে পরিচয় দিতে চাইছে না। এও বুঝলাম, ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণের মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের স্বাধীনতার স্বপ্নের আপাত মৃত্যু হয়েছে। ইউরোপ ভ্রমণে বিদেশী দেখা মাত্রই পরিচয় জানতে চেয়েছি অনেকের কিন্তু একজন কুর্দীর সাক্ষাৎ পাইনি। কুর্দীদের একজন বঙ্গবন্ধু ছিল না বা নেই বলে, তারা ইরাক আর ইরানের খেলার ফুটবল। একদল ফিলিস্তিনী ছাত্র এসেছিল ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দলনেতা বলেছিল, মূলত আমেরিকার কারণে আমরা আজ যাযাবর জনগোষ্ঠী। অতো বড় পৃথিবীতে আমাদের কোনো ঠিকানা নেই। এক খণ্ড ভূমি নেই, বলতে পারি মাতৃভূমি।এই আমেরিকা একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। ইন্দিরা আর ব্রেজনেভ না থাকলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন আদৌ বাস্তাবায়িত হতো কিনা, অথবা আমরা আরেকটি রোহিঙ্গা, কুর্িদ, তামিল বা ফিলিস্তিনী হতাম কিনা, সে এক বিরাট প্রশ্ন।
আমি একাত্তরে ক্লাস সিঙে পড়তাম। একটি মহাকাব্যিক ঘটনা ঘটে গেছে চোখের সামনে দিয়ে। আমাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদের শেষ স্বাক্ষী হারিয়ে যাবে। একাত্তরের পর যারা জন্মেছেন তাদের উপলব্ধিতে স্বাধীনতার সাথে আমাদের ভাবনায় স্বাধীনতা অকেটাই ভিন্ন ।
স্কুলের এসেম্বলিতে জাতীয় সংগীত গাইতাম ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’। বাঙালি মাত্রই স্বীকার করবে, এই সংগীত বাঙালির মনে আবেগ সৃষ্টি করতে পারেনি। এই সংগীতে দেশ প্রেমের কী জোশ ছিল, তার মাথামুণ্ড কিছু্ বুঝিনি। বাঙালি ছেলে মেয়েদের তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে উর্দু আর ফার্সী শব্দ অধ্যুষিত সংগীতটির কোনো মর্মার্থ বুঝার প্রশ্নই ছিল না। বায়াত্তরে এসে ঠিক একই সময়ে এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে গেয়েছি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। এই সংগীতের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চরণ, প্রতিটি স্তবক, পুরো গীতি কবিতাটি, যেন একটি সবুজ প্রকৃতির একটি পেন্সিল স্কেচ। ৮ ফেব্রুয়ারী’ ২২ চট্টগ্রাম বারের নির্বাচন প্রার্থী পরিচিতি সভার শুরুতে শুরু হল জাতীয় সংগীত। জনাকীর্ণ হলরুমে সবার সুরে সুরে যেন স্বর্গ আসলো নেমে ধরনীতে। সম্ভবত; আমাদের জাতীয় সংগীত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একটি। এ জন্যেই বলি আমার ভুবনে স্বাধীনতা একগুচ্ছ বাংলা শব্দ, এক আটি কাশবন, এক ঝুড়ি গোলাপ আর রক্তজবা।
ক্রিকেটে বাংলাদেশী ছেলেরা পাকিস্তানকে হারানোর ম্যাচটির কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ে। ম্যাচ শেষ হতেই চট্টগাম শহরের বাসা বাড়িতে কোনো পুরুষ ছিল না। সবাই রাজপথে। এমন মিষ্টি বিতরণ জীবনেও দেখিনি। রাতের আকাশ হঠাৎ লক্ষ পটকা বাজির বিষ্ফোরণে হয়ে উঠল। যেন সর্ষে ক্ষেতের রঙিন আলোয় ঝলমলে প্রান্তর। বাংঙালি আজ পৃথিবীর আনাছে কানাছে। সেদিন পৃথিবীর সর্ব প্রান্তে দিনের আলোয় বা রাতের অন্ধকারে পত পত করেছে আমার পতাকা। এই পতাকার জন্য আমরা লড়েছি প্রাণপণ। আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে এক শিক্ষাবর্ষ। প্রাসাদসম বাড়ি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। বিনা চিকিৎসায় আমার ভাইটি মারা গেছে। ত্রিপুরা রাজ্যের নয়াটিলার গভীর অরণ্যে তার শ্মশান ভুমি এ জনমে দেখার সুযোগ নিশ্চিতভাবে হবে না। প্রায় প্রতিরাতে কলোনীতে হু হু করে ধ্বনিত হতো মৃত্যুর কান্না। শবদেহের মিছিল দেখতে দেখতে নেমে এলো রুদ্ধশ্বাস প্রথাগত যুদ্ধ। ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বরের কনভেনশনাল যুদ্ধস্মৃতি জীবনের শ্রেষ্ঠ মঞ্চায়িত ট্রাজিক নাটক। আমার ভুবনে স্বাধীনতা মানে শরণার্থী ক্যাম্পে অজস্ত্র মৃত্যু আর রণক্ষেত্রে অজস্র মুক্তিযোদ্ধার প্রাণবির্সজন। এক বীরাঙ্গনা বলেছেন, আমার ইজ্জত গেছে, সংসার হয়নি তাতে কি? আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে।
স্বাধীনতা আমার কাছে আরো একটু বেশী এবং অনেকগুলো ব্যর্থতার কাহিনী। বহুদিন আগে ইয়াসমিন নামের এক মেয়ে ঢাকা শহরের গৃহকর্তার বাসা থেকে বাড়ি যাবে বলে বেরিয়ে গেল। গভীর রাতে ৩ জন পুলিশের হাতে পড়ল এবং বাড়ি পৌঁছে দিবে বলে। ঐ ৩ পুলিশই মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছিল। পুলিশ আছে বলেই আপনি আমি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। অথচ এই পুলিশ যখন একটি অসহায় মেয়ের ইজ্জত আর প্রাণের নিশ্চয়তা দিতে পারে না, তেমন স্বাধীনতা আমি চাইনি। জাপান, জার্মানসহ সব সভ্য দেশে অবলা নারী বলতে কোনো কথা নেই। সব কাজেই নারী সমান পারদর্শী। ঐ সব দেশের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীর পদচারণা নেই। আমিও তেমন স্বাধীন বাংলাদেশ, স্বাধীন সমাজ চেয়েছিলাম। তবে হ্যাঁ আজ যেভাবে মেয়েরা সর্বক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাতে নিশ্চিতে বলতে পারি, আজকের নারীর ক্ষমতায়ন স্বাধীনতার অবিনশ্বর ফসল।
আমার কাকা মুক্তিযোদ্ধা, মামা মুক্তিযোদ্ধা. শ্বশুর মুক্তিযোদ্ধা। সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তরে শুরু হল গড়িমসি। অগত্যা বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ভিত্তিতে দুটো সংবিধান এবং শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা চাইলেন, তাও দেয়া হল না। আমার ভাষা বাংলায় অফিস চলবে, আদালত চলবে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চলবে। উর্দুতে চলতে হলে পাকিস্তান আর বাংলায় চলতে হলে চাই স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, নিম্ন আদালতের বিচার প্রাশাসন, সামরিক প্রশাসন চলছে বাংলায়। এরই নাম স্বাধীনতা। আমার ভুবন আরো বিস্তৃত হতো স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, হয়নি। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর হামলার ইতিহাস। সামিরিক বাহিনী ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। হত্যা করা হয়েছে নিজেদের সতীর্থ খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহের, প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ অসংখ্য সমরকর্তাকে। এমন রক্তাক্ত অধ্যায় আমার স্বপ্নের ছিল না। রক্তাক্ত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বিধস্ত হয়েছে আমার স্বাধীনতার ভুবন।
লেখক: আইনজীবী