২৫ বৈশাখ বাঙালির প্রিয় কবি ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশ প্রকৃতপক্ষে বন্দ্যোপাধ্যায় পদবির বাঙালি ব্রাক্ষণদের অন্তর্ভুক্ত। জানা গিয়েছে অষ্টম শতাব্দীর বৌদ্ধপ্রধান বাংলায় বিশুদ্ধতাবাদী হিন্দুত্বের পুনর্জাগরণ ঘটাতে কনৌজ থেকে আটজন ব্রাক্ষণকে আনা হয়েছিল। দক্ষ ছিলেন তাদেরই একজন। তাঁর বংশধরগণ নানা জায়গায় বসবাস করতে থাকেন। ১৬৯০সালে তাদের একজন বংশধর পঞ্চানন কলকাতার কাছে গোবিন্দপুরে বসতি স্থাপন করেন। যে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূল ঘাঁটি ছিল কলকাতা। তখন অনেক ব্যক্তি অর্থ উপার্জনের জন্য কলকাতা শহরে এসে বসতি স্থাপন করেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা জোড়াসাঁকো এবং পাথুরিয়া ঘাটায় বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকেন।
পিরালি (পীর + আলি) ব্রাক্ষণ বলে ঠাকুর বাড়ির পরিবারকে অবজ্ঞা করা হতো। সেজন্য ঠাকুর বাড়ির পরিবার সামাজিক ধর্মীয় রীতি– নীতিকে গুরুত্ব না দিয়ে সম্পদশালী, স্বাবলম্বী নিজস্ব মতামত ও স্বাধীন সত্তাকে বিকশিত করার জন্য মনোযোগী হয়েছিল। এর ফলে ঠাকুর পরিবার বিশেষ করে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের বংশধরগণ জ্ঞানে, শিক্ষাদীক্ষায়, নৃত্য, গীত, অভিনয়ে, আধুনিকতায় এবং সমাজ কল্যাণে তখনকার যুগে একটি স্বতন্ত্র ধারার অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ভাষাজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি বৃটিশদের অধীনে বড় বড় দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করে বিপুল সম্পদের মালিক হন। তাঁর জীবিতকালে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ছিল না যেখানে তার অনুদান ছিল না। সম্পদশালী এবং কল্যাণমূলক কাজ ও তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁকে সে যুগে সবাই প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্বোধন করতেন।
জোড়াসাঁকোতে ঠাকুর বাড়ির জন্য একটি বিশাল প্রাসাদ বিস্তৃত আংগিনাসহ প্রায় এক একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয়। তখন আরও অনেক শিক্ষিত অর্থশালী ব্যক্তি উৎসাহিত হয়ে জোড়াসাঁকোতে মনোরম অট্টালিকা নির্মাণ করেন। এর ফলে সে সময় জোড়াসাঁকো অভিজাত এলাকায় পরিনত হয় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতিতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির বর্ণনা রয়েছে। জোড়াসাঁকোর পাশেই ছিল বিডন স্কয়ার, সেখানে কংগ্রেসের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুষ্ঠানে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হতো। তিনি উদ্ধোধনী সংগীত হিসেবে বংকিম চন্দ্রের “বন্দে মাতরম” গানটি ঠিক করেছিলেন এবং নিজেই গানটি করেছিলেন। জনসভায় “বন্দে মাতরম” গান গাওয়ার এটাই ছিল প্রথম অনুষ্ঠান এবং গানটি এতো জনপ্রিয় হয়েছিল যে তা প্রায় জাতীয় সংগীতের মত মর্যাদা লাভ করেছিল। (বন্দেমাতরম গানটির সুর বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে ইন্দিরা দেবীর কন্যা সরলা দেবী রচনা করেছিলেন)।
সে সময় কংগ্রেসের সব সভায় ইংরেজিতে বক্তৃতা করা হতো। কারণ জাতীয় আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই ইংল্যান্ডে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাটোরের মহারাজা এবং আরও বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি প্রস্তাব রাখলেন প্রাদেশিক সম্মেলনে যেন বাংলা ভাষাতে বক্তৃতা দেওয়া হয়। নেতারা এর তীব্র প্রতিবাদ করলেন কারণ তাঁদের অনেকে বাংলায় বক্তৃতা দিতে পারতেন না। তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তিনি ইংরেজি বক্তৃতার তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে দেবেন। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবে সবাই সম্মতি দিয়েছিল। প্রায় সময় ডিনারের পার্টিতে সবাই সুটেড– বুটেড হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেতেন ধুতি ও চাদর পরে।
শিলাইদহে জমিদারি দেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সময় সেখানে অনেকদিন থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন “এটা এক দিক থেকে উপকারী হয়েছিল। পরিবারের সম্পর্ক বেড়েছিল। আমরা পাঁচ বাচ্চা বাবা–মাকে আরও কাছ থেকে দেখার অন্তরঙ্গভাবে জানার সুযোগ পেয়েছিলেম। তাছাড়া পেয়েছিলাম প্রকৃতির নিবিড় সংসর্গ।”
গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পছন্দ ছিল না। শিক্ষকদের কাছে তাঁর ছেলেমেয়েরা ইংরেজি, অংক শিখতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসনা ছিল ছেলেমেয়েরা যেন ভারতীয় ধ্রুপদী সাহিত্য বিশেষ করে রামায়ণ ও মহাভারত পড়ে। কিন্তু বই দু’টি বিশাল এবং তাতে অপ্রাসংগিক অনেক বিষয় রয়েছে যা শিশুদের মনের উপযোগী নয়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে বলেছিলেন বাংলা অনুবাদের ওপর নির্ভর না করে সংস্কৃত রামায়ণ থেকে অনুবাদের ওপর নির্ভর করে রামায়ণ রচনার জন্য। মৃণালিনী দেবীর জন্য তা কষ্টকর ছিল। কিন্তু তিনি ঠিকই একজন পন্ডিতের সাহায্য নিয়ে সংস্কৃত রামায়ণ পাঠ করেছিলেন এবং ছোটদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অকাল প্রয়াণের কারণে গ্রন্থটি শেষ করা সম্ভব হয় নি। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন “বাবা আমাদের একাডেমির শিক্ষার দিকটি দেখতেন আর মা দিতেন ব্যবহারিক জীবনের শিক্ষা।”
গুরুজনরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্মতি দিয়েছিলেন। ঠাকুর বাড়ির স্টেটের কর্মচারি বেনীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিনী দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয়েছিল। ভবতারিনী দেবীর তখন ছিল মাত্র দশ বছর বয়স। ভাসুর দ্বিজেন্দ্র নাথ ঠাকুর তাঁকে “স্বর্ণ মৃণালিনী” হবার জন্য আর্শীবাদ করেছিলেন। ভবতারিনী নামটি হারিয়ে গিয়েছিলো “মৃণালিনী” নামের মাঝে। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের লেখা থেকে জানা যায় (কারণ ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলের প্রায় প্রতিটি নারী “দিনলিপি” লিখতেন) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বন্ধুদের স্বয়ং নিমন্ত্রণলিপি পাঠিয়েছিলেন। বাসর ঘরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাঁড় খেলার বদলে দুষ্টুমি করে ভাঁড়গুলো উপুর করে দিয়েছিলেন। ঘোমটায় আবৃত বধূর পানে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা গান করেছিলেন। “…… আ মরি লাবণ্যময়ী………….”।
মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের নির্দেশে ঠাকুরবাড়ি প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মৃণালিনী দেবীকে ঠাকুর বাড়ির আদব কায়দা ও ঘরোয়া বাচনভঙ্গির অভ্যাস করতে হয়েছিল। লরেটোতে ইংরেজি শিক্ষা ছাড়াও তিনি পিয়ানো ও সংগীত শিক্ষা এবং গৃহে সংস্কৃত শিক্ষাও লাভ করেছিলেন। তিনি ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য নারীদের মত ঘরোয়া মঞ্চেও সাবলীলভাবে অভিনয় করেছিলেন। তবে তিনি অন্যান্য বৌঠাকুরণদের মত আধুনিক দীপ্তময়ী হয়ে উঠতে উৎসাহিত ছিলেন না। তাঁর ছিল মমতাময় ব্যক্তিত্ব। অন্যান্যদের সাজিয়ে দিতেন কিন্তু নিজে সাজতেন না। তিনি রূপকথার গল্প সংগ্রহ করে লিখতেন। তাঁর সংগ্রহ থেকে নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর “ক্ষীরের পুতুল” গল্পটি লিখেছিলেন। মৃণালিনী দেবী সরসিক ছিলেন। তাঁর লেখা চিঠিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশি মনে স্ত্রীকে গ্রহণ করেছিলেন। সে খুশির চিহ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র রথীন্দানাথ ঠাকুরেরর লেখায় পাওয়া যায়।
মৃণালিণী দেবী খুব ভাল রাঁধতে পারতেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় আছে “জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যেদিন “খামখেয়ালি সভা”র অধিবেশন হতো সেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অদ্ভুত সব খাবারের কথা বলতেন। তাঁর পছন্দ মত খাবার কীভাবে রান্না করা যায় সেটা বের করতে মাকে যারপর নাই মাথা খামাতে হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্ত্রীকে রাগাবার জন্য বলতেন, “দেখেছো তোমাদের কাজ তোমাদেরকে কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম”। মৃণালিনী দেবী রাগ করে বলতেন “তোমাদের সাথে পারবে কে ? জিতেই আছ সকল বিষয়ে।” অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্রবধু প্রতিমা দেবীকে বলেছিলেন, “বউমা তোমার শাশুড়িকে আমি কত রান্নার মেনু জোগাতুম, আমি অনেক রান্না শিখিয়েছিলুম, উপস্থিত অনেক মহিলা বলতেন। “তিনি তো ভাল রাঁধিয়ে ছিলেন আমরা শুনেছি। কবি হেঁসে বলতেন “ তা তো ছিলেন, নইলে আমার মেনগুলো এত উতরতো কি করে ?”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে একটি পত্রে লিখেছেন, “আমাকে সুখী করবার জন্য তুমি বেশি কোন চেষ্টা কোরো না– আন্তরিক ভালবাসাই যথেষ্ট। —— তোমাকে কোন বিষয়ে আমি ছাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করিনে —– সকলেরই স্বতন্ত্র রুচি অনুরাগ এবং অধিকারের বিষয় আছে—— ভালবাসার দ্বারা যত্নের দ্বারা আমার জীবনকে মধুর। আমাকে অনাবশ্যক দুঃখকষ্ট থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলে সে চেষ্টা আমার পক্ষে বহুমূল্য হবে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল। জোড়াসাঁকোর পরিবারে জীবনের সব ক্ষেত্রে এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শান্তি নিকেতনে আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বাসনা নিয়ে গিয়েছিলেন তখন মৃণালিনী দেবী তাঁর নাবালক পাঁচটি সন্তান সাথে নিয়ে স্বামীর সব কাজে সহযোগিতা করেছিলেন। শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তাঁর সব গয়না বিক্রি করে দিয়েছিলেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “শেষ পর্যন্ত কয়েক গাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন হার ছাড়া তাঁর কোন গয়না অবশিষ্ট ছিল না।”
শান্তিনিকেতনের আশ্রমের ছাত্র–শিক্ষকের খাবারের কষ্ট দূর করার জন্য মৃণালিনী দেবী প্রায়ই তাদের বাসায় নিমন্ত্রণ করতেন। মৃনালিণী দেবী ছিলেন ঠাকুরবাড়ির জননীর মত মমতাময়ী বৌঠাকুরণ। স্বর্ণকুমারী দেবী তাই বলেছেন “তিনি ছিলেন আমাদের বাড়ির জ্যোতির্ময় বউ”।
মৃণালিনী দেবীকে পত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় সম্বোধন ছিল, “ভাই ছুটি”। কে জানতো রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে মমতাময়ী “ছুটি” হঠাৎ করে সত্যি ছুটি নিয়ে চিরতরে হারিয়ে যাবেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনো দু:খ করে বলেছেন “আমি তাদের সব দিতে পারি মাতৃস্নেহ তো দিতে পারি না।” সংসার ও কর্মজীবনের ঘাত–প্রতিঘাতে যখন কষ্ট পেয়েছেন তখন ব্যথায় মর্মরিত অন্তর থেকে উচ্চারিত হয়েছে “এমন কেউ নেই যাকে সব বলা যায়।” স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাই কবিতায় লিখেছেন, “আজিকে তুমি ঘুমাও– আমি জাগিয়া রব দুয়ারে। রাখিব জ্বেলে আলো। তুমি তো ভালোবেসেছো, আজি একাকী শুধু আমাকে বাসিতে হবে ভালো।” শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠালগ্নে মৃণালিনী দেবীর অবদানের কথা রবীন্দ্রানাথ ঠাকুরের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে আমাদের স্মরণ রাখা উচিৎ।
টীকা : বিশিষ্ট এক ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “রবি বাবু আপনার ভাষা অতি চমৎকার, কিন্তু আপনার কি মনে হয় এদেশের চাষা– ভুষোরা আমাদের ইংরেজির চেয়ে আপনার এ বাংলা বেশি বুঝবে ?”
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম।