গ্রীষ্ম যেন এক জ্বলন্ত কবিতা, তবু যার প্রতিটি স্তবক জুড়ে থাকে এক অদ্ভুত টান, মায়া আর স্মৃতির শিহরণ। অনেকে বলে, এ ঋতু রুক্ষ, খরতাপের ঝলসানো হাওয়া বয়ে আনে ক্লান্তি। অথচ আমার কাছে গ্রীষ্ম এক রঙিন মুগ্ধতার নাম, এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে প্রকৃতি তার উজ্জ্বল রং পেন্সিলে এঁকে চলে আবেগের এক রূপকথা। কোকিলের ডাক, পাকা কাঁঠালের গন্ধ, পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে জেগে ওঠে আমার শৈশব।
আমার গ্রীষ্মের গল্পে আছে আমার গ্রামের দিগন্ত জোড়া মাঠ, একটুকরো স্বর্গ। সেখানে একসময় ছিল একটি বিশাল বেলগাছ ছায়াময়, প্রাচীন, প্রিয়। আজ সে গাছ নেই। কিন্তু স্মৃতির পাতায় সে এখনো দাঁড়িয়ে, বাতাসে ঝুলে থাকা আমাদের শৈশবের কল্পনার দোলনায়। গ্রীষ্ম মানেই যেন ছিল আমের মৌতাতে ভেজা এক দুষ্টু আনন্দ। পাকা আমের গন্ধে ভরপুর দুপুরবেলা, পাখিরা ঘুমোতো, আর আমরা ছায়ায় লুকিয়ে রেখে আসতাম শৈশবের উল্লাস।
প্রাইমারি স্কুল ছুটির পর বিলের মাঝখান পেরিয়ে আমরা সবাই দলবেঁধে বাড়ি ফিরতাম। কখনো জলে পা ডুবিয়ে হাঁটা, কখনো কাদার উপর দৌড় সবই ছিল আমাদের ছোট্ট জীবনের বড় আনন্দ। সকালের স্কুলে যাবার আগে মা খেতে দিতেন পান্তা ভাত। মা’য়ের দেওয়া সেই খাবারের স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে, অথচ মা–ই আজ আর নেই। তার অনুপস্থিতি যেন গ্রীষ্মের মাঝেও এক শূন্যতা ছুঁয়ে দিয়ে যায়।
আব্বু শহর থেকে গ্রামে এলে আমাদের পাকা আম দিয়ে গরুর দুধের সাথে মিশিয়ে ‘আম–দুধ–ভাত’ খাওয়াতেন। সে এক অপার্থিব স্বাদ! আজ আব্বুও নেই। কিন্তু সেই সন্ধ্যাগুলো, সেই হাসির মুহূর্তগুলো আমার গ্রীষ্মকে দিয়েছে এক অমর রূপ।
এখনো রুক্ষ দুপুরে আমার তৃষ্ণার্ত মন খুঁজে ফেরে সেই পুকুর, যেখানে কৈশোরের শরীর ভাসিয়ে দিতাম জলে। ডুবে যেতাম, ভেসে উঠতাম, আর জীবনটাকে ছুঁয়ে দেখতাম শিশুসুলভ সাহসে। সেই সাতার কাটার মুহূর্তগুলো যেন ছিল জীবনের সঙ্গে প্রেমে পড়ার প্রথম ধাপ।