‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বোচ্চ সম্মানজনক প্রতিযোগিতার নাম হচ্ছে অলিম্পিক গেমস। অলিম্পিকের মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘ফাস্টার, হাইয়ার অ্যান্ড স্ট্রংগার’। অলিম্পিক গেমসের গুরুত্বপূর্ণ আপ্তবাক্যটি হলো, টু পার্টিসিপেট। জয়ী হওয়া নয়, গেমসে অংশ নেওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। এমন হৃদয়ছোঁয়া কথামালায় ১৮৯৬ সালে এথেন্সের প্যানাথেনেইক স্টেডিয়ামে যে অলিম্পিকের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ পৃথিবীতে মর্যাদার অপর নাম হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের ধনাঢ্য দেশগুলো অলিম্পিক আসরের হোস্ট হওয়ার জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করে। চোখ ধাঁধানো নানা আয়োজন থাকে অলিম্পিকের আসর ঘিরে। এবার অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। আজ প্যারিস অলিম্পিকের পর্দা নামছে। বিশ্বের শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত প্যারিসে অনুষ্ঠিত এবারের অলিম্পিকের নানা আয়োজন দেখতে দেখতে গত ক’দিন ধরে খুব মনে পড়ছিল আমার নিজের অলিম্পিক দেখার দিনগুলোর কথা। লিখব লিখব করেও নানা কারণে পেরে উঠছিলাম না। আজ মনে হলো, আমার অতীতের সেই বর্ণিল স্মৃতি দৈনিক আজাদীর পাঠকদের সাথে শেয়ার করি।
১৯৯৬ সাল। আমেরিকার আটলান্টায় বসছে অলিম্পিকের আসর। ডালাসে আমার বন্ধু পালিতকে অলিম্পিক দেখতে যাওয়ার আগ্রহের কথা জানালাম। সে এক পায়ে খাড়া। বলে, চলে আস। আমার আমেরিকায় যাওয়া উপলক্ষে সে চাকরি থেকে টানা ছুটি নেয়।
ডালাসে গিয়ে তার বাসায় উঠি। ঠিক হলো, ডালাস থেকে পালিতের গাড়ি নিয়ে আমরা আটলান্টায় যাব। আটলান্টায় হোটেলে থাকব। অলিম্পিক ভেন্যুর ধারেকাছে হোটেল না পাওয়ায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে একটি হোটেলে রুম বুকড করে রাখল পালিত।
ডালাস থেকে আটলান্টার দূরত্ব প্রায় ৮শ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়িতে গেলে ১২/১৩ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। আমরা কয়েকদিনের জন্য তল্পিতল্পা গুছিয়ে যাত্রা করলাম আটলান্টায়, পালিতের গাড়িতে। পালিত ড্রাইভ করছিল। সে ক্লান্ত হলে আমি সহায়তা করব, এমন কথাও হলো।
টিভিতে খবর দেখাচ্ছিল, অলিম্পিক আসর ঘিরে আটলান্টায় চার স্তরের নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয়টি কোনোভাবে ‘ভাঙা’ গেলেও তৃতীয় এবং চতুর্থ স্তর ভেদ করা অসম্ভব। কিছুটা ভয় পেলেও নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, আমরা তো সন্ত্রাস করতে যাচ্ছি না, অলিম্পিক দেখতে যাচ্ছি। সুতরাং আমাদের ভয় পাওয়ার কি আছে!
প্রায় ১৩ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমরা আটলান্টায় পৌঁছলাম। আগে থেকে বুকড করে রাখা হোটেলে পৌঁছে ডিনার সেরে ঘুমাতে গেলাম। সকালে নাস্তা সেরে ছুটলাম টিকেটের খোঁজে। চার স্তরের নিরাপত্তা ভেদ করে ভেন্যুর টিকেট কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব কিনা তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। কিন্তু আমরা গাড়ি চালিয়ে নির্বিবাদে ভেন্যুর কাউন্টারের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। কেউ একটি কথাও জিজ্ঞেস করল না। কোথায় যাব, কেন যাব তাও জানতে চাইল না। চার স্তরের নিরাপত্তার এমন দশা দেখে কিছুটা হতাশ হলাম। নিজেকে আবারও সান্ত্বনা দিলাম, হয়তো এটি আমেরিকান স্টাইল। তারা মনে হয় স্যাটেলাইট–ফ্যাটেলাইট দিয়ে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রেখেছে।
মজার ঘটনা ঘটল টিকেট কাউন্টারে। ধবধবে ফর্সা এক লোক কাউন্টারে বসেছিলেন। টিকেট আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি হাত এবং ঠোঁট একইসাথে উল্টে বললেন, নট এভেলেবল। মানে নেই। হতাশ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হয় তার মায়া হলো। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনকে দেখিয়ে বললেন, ওদের কাছে টিকেট আছে। ওখান থেকে বাড়তি দামে নিতে পারো।
সাগরে ডুবতে ডুবতে মানুষ কিছু একটা ধরতে পারলে যেমন আশ্বস্ত হয়, আমার অবস্থাও তেমন হলো। টিকেট পাওয়ার ক্ষীণ আশায় পুলকিত হলাম। কিন্তু বিপত্তি বাধল ওই লোকগুলোর কাছে গিয়ে। তারা নিজেরাই ‘ডু ইউ হ্যাভ টিকেট?’ বলে টিকেট খুঁজছিল।
কাউন্টারে গিয়ে কথাটি বলতেই ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, এটা চালাকি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে তারা ‘ডু ইউ হ্যাভ টিকেট’ বলে। দে আর সেলিং টিকেট।
আবার ছুটলাম। এবার হাতে হাতে ফল পেলাম। ওরা আসলেই টিকেট বিক্রি করছিল। আমাদেরকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে বলল, জেনারেল গ্যালারির একদিনের ২৫ ডলারের টিকেট ৭৫ ডলার দিতে হবে। বঙের এক সপ্তাহের টিকেট ১২৫ ডলার।
বঙের টিকেটগুলো বিক্রি হচ্ছিল না বলে তারা কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে বলে আমার মনে হলো। আমাদের মনে হলো, একদিনের টিকেট ৭৫ ডলারে না নিয়ে এক সপ্তাহের টিকেট ১২৫ ডলারে নেওয়া ভালো। আমি পালিতের সাথে পরামর্শ করে তাদের সাথে দরাদরি শুরু করলাম। দুটি টিকেট কিনব বলায় তারা ১১০ ডলারে দিতে চাইল। আরো দরাদরি করে ১০০ ডলার করে দুটি টিকেট কিনলাম। আটলান্টা অলিম্পিকের টিকেট হাতে পেয়ে আমার মনে হয়েছিল আকাশের চাঁদ পেয়েছি।
টিকেট নিয়ে ঢুকে দেখি এলাহি কারবার। বঙের ভেতরে চারজনের বসার আয়োজন। সামনে টেলিভিশন। কিছুক্ষণ পর পর এক তরুণী কফি সার্ভ করছিল। একেবারে ফ্রি। আমরা কফি খেতে খেতে অলিম্পিকের নানা ইভেন্ট দেখছিলাম। যেটি একটু দূরে হচ্ছিল সেটি দেখার জন্য সামনের টিভিতে চোখ রাখছিলাম। এভাবে টানা সাত দিন আটলান্টা অলিম্পিকের নানা ইভেন্ট দেখে আমার মনে হয়েছিল, শুধু ভাগ্যগুণেই এমন আসরে সামিল হতে পারলাম।
আসলেই আমি নিজেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান মনে করি। এই কারণে যে, যা চেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি জীবনে পেয়েছি। মহান আল্লাহর কাছে এজন্য শোকরিয়া আদায় করি।
১৯৭৪ সালে আমেরিকার দুইশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশ্বের ২৯টি দেশের ২৯ জন সাংবাদিক পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র আমিই ওই আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। ‘ভিজিট আমেরিকা’ নামে একটি প্রোগ্রামে গিয়ে সস্ত্রীক টানা দুই মাস ছিলাম আমেরিকায়। আমেরিকান সরকার আমাদেরকে একটি মোবাইল হোম দিয়েছিল। দুই মাস ধরে গাড়ি চালিয়ে এবং রাতে ওই গাড়িতে লাগোয়া ঘরে ঘুমিয়ে আমেরিকার ৩৩টি রাজ্য ঘুরে দেখেছিলাম। আহা, ওই যাত্রায় কত দর্শনীয় স্থানই না দেখেছি!
ভাগ্যের ফেভার নিয়ে যখন বলছি, তখন আরো একটু লিখি। লন্ডনে বেড়াতে গিয়েছিলাম একবার। শুনলাম, কাছেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মাইকেল জ্যাকসনের কনসার্ট। আর যাই কোথায়! গিয়ে হাজির হলাম। টিকেট কিনে মাঠে দাঁড়িয়ে মাইকেল জ্যাকসনের বিখ্যাত সব গান শুনলাম, দেখলাম তাঁর বিশেষ মুদ্রার নাচ ‘মুনওয়াক’। কী দুর্দান্ত পারফরমেন্স!
আমেরিকার লাস ভেগাসে বেড়াতে গিয়েছিলাম একবার। গিয়ে শুনি সেখানে বসছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা এবং অন্ধ গায়ক স্টিভ ওয়ান্ডারের গানের আসর। পৃথিবীখ্যাত এই কিংবদন্তীর গান না শুনে কি থাকা যায়! আমি ভাগ্যবান যে, স্টিভ ওয়ান্ডারের সামনে বসে শুনেছিলাম তাঁর দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পাওয়া বিখ্যাত সেই গান, ‘আই জাস্ট কলড টু সে আই লাভ ইউ’।