আমাদের লোকসংগীতের উৎস

ইকবাল হায়দার | শুক্রবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

সংগীতের দুই দিগন্ত। সাধনা আর স্বপ্ন, অন্যটি প্রয়াস এবং প্রেম। ললিত কলার সবচেয়ে লোক নন্দিত শাখা অনুষদের নাম লোকসংগীত। এর বিষয় দৃশ্যমান আমরা প্রায়শ দেখি দেশ, প্রকৃতি বিশেষ করে নদী যার অন্তহীন বহমানতা ও নিরন্তর ভাঙাগড়া নিয়ে জীবনেরই প্রতীক আর অতিন্দ্রিয় এক জগতের হাতছানি লোক সংগীত যা বাংলাদেশের মরমের গান। এর সুর বাংলার হৃদয়ের সুর। যে সুর মরমী কণ্ঠে মরমীর মত ঝরে পড়ে।

এ দেশের ঘাসের রঙে অবিনশ্বর সবুজ আছে, এ দেশের রৌদ্রের মাঠে কলাবতী রমনীর মনোরম ভাবনা আছে, সেই সবুজ সেই মনোরম ভূমিকা এদেশের লোক সংগীতে সবুজ ঘাস ও নরম রোদের প্রবাহের মত বসবাস করে।

সুজলাসুফলা শস্য শ্যামলা প্রকৃতির অপরূপ দানে সমৃদ্ধ রূপে রসে বর্ণে, গন্ধে ও বৈচিত্র্যে ভরপুর আমার বাংলাদেশ। হাজার ফুলের ঘ্রাণ ভরা, চাঁদ সুরুজের আলোয় গড়া, ধানের দেশ গানের দেশ বাংলাদেশ। যখন বসন্তের কোকিল গেঁয়ে ওঠে আপন মনে তাতে পাই লোক সংগীতের সুর। পড়ন্ত রৌদ্রের লাল আভা গায়ে জড়িয়ে যখন গান গেয়ে কৃষাণ বাড়ী ফেরে তখন লোক সংগীতের গন্ধ পাই। যখন শরতে সাদা মেঘের ভেলা ভাসে, কাশফুলগুলো বাতাসের দোলায় নাচতে থাকে তখন পাই লোক সংগীতের রূপ। কাঁদা মাটির সোঁদাগন্ধ মৌ মৌ ঘ্রাণে যখন মনটাকে আকুল করে তখন পাই লোক সংগীত।

পল্লী বাংলার আপামর মানুষের দুঃখ, শোক, প্রেম, বিরহ, জাগতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, লোক সংগীতের উপাদান। তার সুর পাই মাঠে, ঘাটে, নদীতে, হাওয়ে, বনে বনে, জংলায় শুনি লোক সংগীতের সুর।

লোক জগৎ থেকে আহরিত লোক কথা, লোক সুরে ভরা, মানুষের মুখে মুখে রচিত ও প্রচার এ লোকসংগীত লোক সমাজের সম্পদ। লোক সংগীত জন সমাজের সৃষ্টি। লোক সংগীতের কলি যেন পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় ঢেউয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে জোয়ারে ভেসে আসে।

লোকসংগীতের আবহ সৃষ্টির মূল নিয়ামক এদেশের প্রকৃতি, নদীনালা, খালবিল, হাওর বাওর, জল, বৃৃষ্টি ও বর্ষা। দেশ ও প্রকৃতি, নদী, পাখী, ফল, ফুল দেশমাতৃকার কথা এ গানের প্রতিপাদ্য বিষয় যার বাঁশীর সুর স্বচ্ছ ও প্রাণবন্ত। ভৌগলিক প্রকৃতি ঋতু বৈচিত্র জনবসতির জীবন ও বৈশিষ্ট্য সামাজিক রীতি নীতি লোকাচার, বিশ্বাস, সংস্কার, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গী। পরিবর্তনশীল মানসিক গঠন লোক সংগীতের উপাদান।

এ গান চিরকালের অজ্ঞ, অশিক্ষিত, উদার চিত্তধারী ও ভাব পন্থীদের গান, লোক সংগীতে কথা ও সুরে থাকে মানুষের বেদনা ভেজা কান্নায় শৈল্পিক প্রকাশ।

প্রবাহিত নদীর স্থির জলে মৃদু শান্ত ঢেউয়ের ওঠা নামার মতো হবে লোক সংগীতের অবিনাশী সুর। গানের দেশ, ধানের দেশ, নদীর দেশ, বাংলাদেশ। নদী পাড়ের মানুষের জীবন, প্রকৃতি, আকুতি, স্বজন শূন্য নারী পুরুষের বার্তা, নদী, নৌকা, মাঝি, বেদনার্থ নরনারীর হৃদয় গহন থেকে ওঠে আসা হাহাকারের সঙ্গী লোক সংগীত। ভাটির গানে, নদীর টানে, যে সুর আমাদের মনকে দোলা দেয়, সতেজ ও আনন্দময় করে তোলে সেটি লোক সংগীত যা শিরায় কণ্ঠে অনুরনিত হয়।

যে গান হাটে, বাজারে, মাঠে, ঘাটে, মানুষ ও জনতার মুখে মুখে ফিরে তাহা লোকসংগীত। হাজার হাজার বছর ধরে এদেশের মাটি, বায়ু ও প্রকৃতির সঙ্গে লোকসংগীত মিশে আছে। লোকসংগীত বাংলার রূপ সৌন্দর্য্য তথা বাংলার চিরন্তন অবস্থায় কথা তুলে ধরে।

লোকসংগীতের জননী হল আদিম সংগীত। আদিম মানুষের কাজে সংগীত ছিল জীবনের এক অপরিহার্য অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দেশজ মেঠো সুর, আঞ্চলিক ও স্থানীক বিশিষ্ট্যসহ দৃশ্যে, চিত্রকলায়, রূপকে, উপমায়, অনুষঙ্গে, উদাহরণে যা লোক জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে তাই লোকসংগীত ।

লোকসংগীত গণমুখী গান গুরুমুখী না। এর আছে বাহিরানা ঘরানা নেই। বিষয় বাংলাভাষী জনগণ, নদী যেমন জালের মতো ঘিরে আছে এদেশ। ঠিক তেমনি নদীর জলের মত বহমান লোকসংগীতের কথা ও সুর। লোকসংগীত শ্রোতা দর্শককে পুলষিত, চমকিত, চকিত করে। অপার্থিব জগৎ, ধর্মীয়ভাব, মরমী সুর, প্রার্থনা, প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, আত্মোপলব্ধি আত্মজিজ্ঞাসা, মারফতি, মুর্শিদী, কীর্তনীয়া, বাউল, জারি সারি, জীবনগীতি, কর্মসংগীত, ইসলামী গান, হামদ, নাদ, দেশাত্ববোধক গান, পুঁথি, কবিগান, মেয়েলী গীত, লোক সংগীতের ধারা সৃষ্টির মূল নিয়ামক।

অপার সৌন্দর্য্যে ভরা লোক সংগীতের বাণী ও সুর। যা স্বচ্ছ ও প্রাণবন্ত। মানুষের মুখের ভাষাকে, মানুষের চিরন্তন বেদনাকে, চিরন্তন প্রেমবোধ ফুটিয়ে তোলাই লোক সংগীতের কাজ।

নদী, জনপদ, প্রকৃতি আর মানুষের অন্তর যেমন এ গানের বাণী ও সুরের দোলায়িত ছন্দের ও তরঙ্গের সাথে একাকার হয়ে যায়। স্রোতমান বাস্তবের পথরেখা ধরে মানুষের মন যেন এক রহস্যময় মরমীয়তার দিকে ধাবিত হয়। মানুষের মনের কথা এবং অনুভূতি ও কষ্টের কথা বলে লোকসংগীতের মাধ্যমে। প্রেমিক প্রেমিকা হৃদয়ের আর্তি, প্রেয়সীর জন্য অপেক্ষামান প্রেমিকের আকুতি প্রকাশ পায় লোক সংগীতের কথা, সুর ও অভিব্যক্তিতে।

জ্ঞানের অতীত, অলৌকিক জগতের গুরুত্ব নিহিত আছে এই লোক সংগীতের কথা ও সুরের আর্তিতে। ঐশী প্রেম, স্রষ্টার অস্তিত্ব ও স্বরূপ, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, মানুষের পূর্বাপর অবস্থার বর্ণনা লোকসংগীতে ঝংকৃত হয় বাঁশী ও সুরে। এ গানে প্রেম, ভক্তি, ভালবাসার নানা কথা সরস সৌন্দর্য্যে মূর্ত হয়ে উঠে। ধর্ম কেন্দ্রিক সাধনা ও ধর্মীয় প্রভাব এ গানে প্রবল থাকে।

কোমল মাটি ও এদেশের মানুষের অন্তর প্রকৃতির রূপ, রঙ, গন্ধ, বর্ণ, শব্দ, সৌন্দর্য্যের অমৃত ধারায় পরিপূর্ণ আমাদের লোকসংগীত যা মানব মনকে আনন্দ রসে আবেগাপ্লুত করে।

লোকসংগীতের সাহায্য মানব মনকে, লোক সমাজকে, সুর, ছন্দ, আবেগ দিয়ে আপ্লুত আনন্দে রসে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন দরাজ সাবলীল কণ্ঠ। শিল্পী নিজেকে সবকিছু ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণ সুরে উজার করে দেবে। গীত রীতিতে প্রয়োজন স্বর্ণাভ দ্যুতিময় উপস্থিতি, প্রয়োজন আন্তরিকতা, প্রাণ ও আঙিকে থাকবে মূলত পল্লী বা লোক সমাজের কথা। লোকসংগীতের জন্য প্রয়োজন ভরাট গলার স্বর। এ সংগীত শিল্পীর কণ্ঠে সুমিষ্ট সুর শুললিতভাবে ধ্বনিত হয়। তার কারণ প্রত্ম উপাদান, সমাজ কাঠামোর প্রভাব, সর্বোপরি ভুগোল ও জলবায়ুর প্রভাব।

লোকসংগীতের জন্য প্রয়োজন মার্জিত, মিষ্টি, কোমল, ভরাট প্রমিত কণ্ঠ। বেশী স্থুল ও নয় বেশী সুক্ষ্ম ও নয়। ত্রি সপ্তক অবিকৃত, দূর থেকে শ্রবণযোগ্য অথচ চওড়া আওয়াজ, জোরজার কণ্ঠ, কাঁপা ও ফাটা নয়। অনুরাগ সৃষ্টি করে করুণাযুক্ত কণ্ঠ, উচ্ছ্বল কণ্ঠ, প্রক্ষেপণ শৈলী সুরের কারুকাজ ও অলংকারের ব্যবহার। ছন্দ বিন্যাস লয় কারক রস ব্যঞ্জনা সৃষ্টি, প্রক্ষেপণ শৈলী কণ্ঠে তারের মত শব্দ।

বাংলার মাটি, জল, আলো, হাওয়া, বন, বাদাড়, প্রান্তর, নদী, খাল, সমুদ্র, পোতাশ্রয়, বৃক্ষলতা, গুল্ম, সুর, তাল, লয়ে জেগে উঠে লোক সংগীত।

ভাটির গানে, নদীর টানে যে সুর আমাদের দোলা দেয় মন প্রাণকে সতেজ ও আনন্দময় করে তোলে সেই গান ও লোক সংগীত শিরার কণ্ঠে অনুরনিত হয়। যেমন উজানের গান ভাটিতে আর ভাটির গান উজানে জল ও জীবন নদী ও মানুষেরা প্রবাহমান তার শাশ্বত সূত্র। ভাটিয়ালী গানের সুর অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে রেখেছে নদীকে যেমন দেহের রূপক নৌকা, নদী, ঘর।

নদীর স্রোতের প্রভাবে সৃষ্ট ভাটিয়ালী গান মিশে আছে দেশজ মেঠো সুর তার সঙ্গে দৃশ্যমান চিরায়ত আমাদের আঞ্চলিক ও স্থানীয় সুরের বৈশিষ্ট্য।

আবার মুর্শেদি, মারফতি, আধ্যাত্মিক, মরমী গানে প্রস্থান দৃশ্য হয় লোকসংগীতে, মরমী কবি ও আধ্যাত্মিক শিল্পীর গানে। মুর্শেদ শব্দের অর্থ গুরু। তারা সুরে সুরে একতারা দোতারায় ঝংকার তোলে গুরুর নামে ভক্তের হৃদয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লোক সংগীতে। এ যেন ঐশী প্রেমের এক রূপ। গুরুর প্রেমভক্তি ভালবাসায় নানা কথা লোক সংগীতে সরস সৌন্দর্য্যে মূর্ত হয়ে ওঠে।

আবার ভাটিয়ালী গানের সঙ্গে বাংলার প্রকৃতির নিবিড় ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিদ্যমান। এই গানের উৎজীব্য বিষয় শুধু প্রেম নয়, প্রেমকে অতিক্রম করে এক আধ্যাত্মিক আত্মার উত্তরণ ঘটায়।

আরও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের লোকসংগীতের বিশাল ভান্ডারে আছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, মাইজভান্ডারী গান, বিচ্ছেদী হাওলা গান, সিলেটের ধামাইল গান, হাছন রাজার গান, শাহ আব্দুল করিমের গান, রাধারমনের গান, শীতালং শাহর গান, দুর্বিন শাহর গান, আরকুম শাহ গান, রকিব শাহ গান, কালাশাহের গান, উত্তর বঙ্গের ভাওয়া গান, রাজশাহীর গম্ভীরা গান, কুষ্টিয়ায় লালন শাহর গান সহ দুদ্দুশাহ, পাগলা কানাই ইত্যাদি।

কবি গান, জারি গান, সারি গান, গম্ভীরা, বাউল গান, ভাওয়াইয়া পল্লীগীতি, আধ্যাত্মিক মরমী, বিচ্ছেদী দেহতত্ত্ব মাইজভান্ডারী, অহীরা গান, আলকারা, কৃষাণ গান, গাজীর গান, ঘেটু গান, ছেঁচর গান, জাওয়া গান, জাগ গান, ঝুমুক ঝাপান, টুসু গান, তরজা গান, ধামাইল গান, ধূয়া গান, পটুয়ার গান, পটু গান, পাঁচালী পালা গান, বারমহিষা, ভাজোর গান, ভাদু গান, ভাষাণ গান, লেটো গান শিলারীক গান, হ্যাপু গান, হাদুমা গান, হোল বোল, হোলী গান। মানব মনের চিরন্তন ব্যথা বেদনা আবেগ উদ্ভাস থেকে উৎসারিত।

লেখক : সংগীতশিল্পী, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোগীর সেবা ও রোগী দেখা: নবী করিম (সা.) এর সুন্নত ও সর্বোৎকৃষ্ট নেক আমল
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা