আমাদের রবি

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৪ জুলাই, ২০২৪ at ৪:০৩ অপরাহ্ণ

বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাঁর সৃষ্টিশীলতা হাজার বছর ধরে বাঙালির হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাবে। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, তিনি বিচরণ করেননি।

কবি ছোটদেরকে কখনও অবহেলার চোখে দেখেননি। কবি ছোটদের নিয়ে লিখেছেন-‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁেক বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি…./ সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে/ আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোট মাছ ধরে/ আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভরো ভরো/ মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর/ দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সারা/ বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া’। কবি পাখি নিয়ে লিখেছেন-‘কিচিমিচি করে সেথা/ শালিকের ঝাঁক/ রাতে উঠে থেকে থেকে/ শেয়ালের হাঁক’।

প্রকৃতির কবি, প্রেমের কবি, ভালোবাসতেন বৃষ্টিও। পাখির কিচির মিচির গান গাওয়া, নদীর কলকল ছলছল ছুটে চলার ধ্বনি কবির মনকে আনন্দ দিয়েছে। নদীর কথা, বৃষ্টির কথা, পাখির কথা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার ছড়াকবিতায়। আষাঢ় মাসের মেঘ দেখে কবি বলেছেন-‘নীল নব গনে আষাঢ় গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ ও গো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’

বৃষ্টির পর আকাশে রোদ উঠেছে। রংধনুর সাত রঙের লুকোচুরি খেলা। বেজে উঠেছে স্কুলের ছুটির ঘণ্টা। বাঁধ ভাঙা ছেলেমেয়েদের বাড়ির পানে ছুটে চলা। রংধনুর সাত রঙের সঙ্গে এ সময় ছেলেমেয়েরা আনন্দে মেতে উঠে। এই আনন্দের মুহূর্তে আরও একটু বেশি আনন্দ দিয়ে গিয়ে কবি লিখেছেন-‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/ বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই/ আজ আমাদের ছুটি।’

মা পালকিতে করে যাচ্ছিলেন। আর খোকা যাচ্ছিল মায়ের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে। মা তখন ভীষণ ভয় পাচ্ছিলেন। ডাকাতের ভয়ে মা ভেঙে পড়েছেন। ‘তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে/ ঠাকুরদেবতা স্মরণ করছ মনে/ আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে/ আমি আছি, ভয় কেন মা করো।’ কবি মা’কে এভাবেই সাহস দিয়ে যাচ্ছিলেন। কবির ইচ্ছে হলেই মা’কে নিয়ে দেশবিদেশে ঘুরে বেড়াতেন। কখনও রাজপুত্র হয়ে আবার কখনও বীরপুরুষ হয়ে। মা খোকাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আর তাইতো কখনও না করতে পারেননি। খোকার যে কোনো ইচ্ছাই মা হাসি মুখে মেনে নিতেন। খোকা এখানেও তার ইচ্ছার কথাটি বলতে ভুল করেনি।

চাঁদকে নিয়ে কতো গল্পকবিতাছড়া লেখা হয়েছে তার হিসেব নেই। চাঁদ শিশুদের যেমন প্রিয়, তেমনি বড়দেরও। চাঁদকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রচুর লিখেছেন। ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।’

কবিগুরুর ছড়ায় ছড়িয়ে রয়েছে মজা, মিশে রয়েছে অদ্ভুত সব কাহিনি। তিনি কখনো হেঁটেছেন বাস্তব জগতে, আবার কখনো বিচরণ করেছেন কল্পনার জগতে। শিশুদের মনকে বুঝতেন বলেই তাদের উপযোগী রচনায় তিনি ছিলেন দক্ষ। তাঁর ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছড়া’ ইত্যাদি বই ছোটদের আনন্দে ভাসিয়ে দিয়েছেন। ছোটদের জন্য তিনি কখনো ছোট হয়েছেন, আবার কখনো নিজে ছোটদের উদ্দেশে বড় হয়ে লিখেছেন। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে।’ তখন মনে হয়, কোনো চিরপরিচিত গ্রামের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তালগাছটা একটা মানুষ হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো আবার তিনি হয়ে গেছেন মাঝি। ‘আমার যেতে ইচ্ছে করে/ নদীটির ওই পাড়ে/ যেথায় ধারে ধারে/ বাঁশের খুঁটায় ডিঙি নৌকা/ বাঁধা সারে সারে।’

ছোটদের জন্য রচনা করেছেন নাটকও। কবির ‘ডাকঘর’ নাটকটি সবার কাছে প্রিয়। অমলের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার প্রত্যাশা সব শিশুর অন্তরের ইচ্ছাকে প্রকাশ করে। দইওয়ালার ডাক শুনে মনে হয় আমাদের ঠিক পাশ দিয়ে যেন দইয়ের ডুগি নিয়ে ছুটে চলেছে কোনো লাল মাটির দেশের দইওয়ালা। কিন্তু বর্তমানের নাগরিকশিশু ‘দইওয়ালা’ চিনে না বললেই চলে। তারা কল্পনার জগতে ‘দইওয়ালা’ খুঁজে পায় এই নাটকে। কবির ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের কথা যে একবার পড়ে সে আর তাকে ভুলতে পারে না। কবির প্রতিটি সৃষ্টিকর্মে রয়েছে গভীর মমত্ববোধ, ভালোবাসা। সবার জন্য সাহিত্য রচনার জন্য তিনি সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিথিদের বন্ধুত্ব
পরবর্তী নিবন্ধঅভিনয়কে ঘিরেই স্বপ্ন সাঈদ নিলয়ের