আমাদের বিধানদা

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ১৭ মার্চ, ২০২৫ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

এ শহর আরও একজন অভিভাবককে হারালো। চলে গেলেন আমাদের সকলের প্রিয় বিধানদা। বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন স্থপতি। সংস্কৃতির সব শাখায় ছিল তাঁর আগ্রহ ও চলাচল। বিশেষ করে চলচ্চিত্রে। ছাত্রাবস্থা থেকে চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াকালীন সময়ে সেখানে গড়ে তুলেছিলেন ফিল্ম ক্লাব। সে সময়ে আলমগীর কবিরের পরিচালনায় ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সও করেন। ১৯৭১ সালে শরণার্থী হয়ে কলকাতা গেলে সেখানে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হয়ে বিশ্বচলচ্চিত্র আস্বাদনের বড় সুযোগ পান। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের শেষে দেশে ফিরে ১৯৮৮ সাল থেকে চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন যে সংযুক্তি অব্যাহত ছিল পরবর্তী জীবন। চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আয়োজনে কোস্টা গাভরাস রেট্রোসপেকটিভে অসুস্থ শরীর নিয়েও গত ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যায় সস্ত্রীক উপস্থিত হয়েছিলেন আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। সেই সন্ধ্যায়ও অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে বরাবরের মতো প্রাণবন্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা। ইনস্টিটিউটের প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাঁর সানন্দ উপস্থিতি ছিল অবধারিত।

বিধান বড়ুয়া বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা স্থপতি। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিকের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। তাঁর স্থাপত্যকর্মের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর তিনি বেশি জোর দিতেন। পাশাপাশি নান্দনিক অভিনবত্বও থাকতো তাঁর কাছে। তাঁর অনিন্দ্য স্থাপত্যকীর্তির প্রচুর নিদর্শন দেশেবিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। দু’টি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন; মাইজভান্ডার শরীফের হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর মাজার ও ভাটিয়ারির বিএমএ গেট সংলগ্ন এক মার্কিন ভদ্রমহিলার বাড়ি ও শিশু সদন। দু’টি স্থাপত্য এমনভাবে তৈরি, যেখানে কৃত্রিম আলো বাতাসের প্রয়োজন পড়ে না। নান্দনিকতার দিক থেকেও অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। সুষ্ঠু পরিকল্পনার বিষয়টি বিধানদার সব কাজের মধ্যেই ছিল। ছিল চলনেবলনে। কথা বলতেন কম। যেটুকু বলতেন তা খুব গোছানো। বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন, ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম’ নামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠন যার উদ্দেশ্য ও বিধেয়চট্টগ্রামকে সত্যিকার অর্থে প্রাচ্যের রাণী রূপে গড়ে তোলা। তাদের কল্যাণে চট্টগ্রামের অনেক প্রাচীন ইমারত, পাহাড় ও পাহাড়ি পথ রক্ষা পেয়েছে। যেমন জেনারেল হাসপাতাল ও আদালতের প্রাচীন ভবন, সার্সন রোডের কয়েকটি সরকারি ভবন সংযুক্ত পাহাড় ও বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়ক। বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কটিতে মাটি ভরাট করে সড়কটির উঁচু নিচু বৈচিত্র্যকে বিনষ্ট করে সমান করার পাঁয়তারা করা হয়েছিল। তেমনি হালদার মোহনা থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত কর্ণফুলির তীর ঘেঁষে নদী তীরবর্তী সড়ক ও উদ্যান গড়ে তোলার প্রথম প্রস্তাবটি আসে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম থেকে, যা ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় শুরু হয়ে কিছুদূর এগোনোর পর বন্ধ। তবে হালদার মোহনা থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত অত্যন্ত ধীরগতিতে কাজ চলছে। তবে কোনো বৃক্ষরোপণ হচ্ছে না তীর ঘেঁষে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে মাঝে মধ্যেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। এসব দুর্যোগের কারণে অনেক প্রাণহানি ঘটে। বিপর্যস্ত হয় প্রকৃতি। প্রতিবারই বিধানদা একটা কথা বলতেন, ঘন ঘন এত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নেপথ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলির ক্রমাগত শিল্প উদ্যোগ ও নানা রকমের তথাকথিত প্রতিরক্ষা ও কারিগরি পরীক্ষা নিরীক্ষাই দায়ী। কাজেই হয় তাদেরকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নয় তাদের কাছ থেকে অনুদান কিংবা ঋণ নিয়ে পুরো উপকূল জুড়ে উঁচু বাঁধ দিলে জালোচ্ছ্বাসের কবল থেকে রক্ষা পাবার পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন উন্নত হবে, তেমনি পর্যটনেরও একটা বড় সুযোগ তৈরি হবে। এসব কথা তিনি বিভিন্ন সভা সমিতি সেমিনারে বলতেন। প্রবর্তক পল্লীতে পাহাড়ের ঢালে বিধানদার স্থাপত্যে পঞ্চতল বিশিষ্ট তাঁদের বাড়িটিও সুরম্য ও পরিবেশবান্ধব।

স্থাপত্যকলায় অধ্যয়নরত অবস্থাতেই শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে শাস্ত্রীয় ও রবীন্দ্রসংগীত এবং চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। স্থাপত্যকলার সঙ্গে সংগীতের অনেক সাদৃশ্যগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি বলতেন। চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা নিবন্ধের শুরুতে বলেছি যা তাঁর জীবনের প্রান্তসীমা পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। চলচ্চিত্র নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করতেন। চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রচুর গ্রন্থ ছিল তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে (বাড়ির নিচ তলায়) যার অনেকগুলি তিনি নিয়ে এসেছিলেন দেশে ফেরার সময়। বিধানদার ফিল্ম সেন্স বিমোহিত করতো আমাদের। বলা বাহুল্য আমরা অনেকেই প্রভাবিত হয়েছি তাঁর চলচ্চিত্রভাবনায়। উনার পছন্দের পরিচালক ছিলেন সত্যজিৎ রায় এবং রিচার্ড এ্যাটেনবরো। পথের পাঁচালি ও গান্ধী এদুটি ছবি সময় পেলেই দেখতেন এবং আলাপ করতেন ছবি দু’টির বিভিন্ন দিক নিয়ে। ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের তিনি ছিলেন চেয়ারম্যান। তাঁর সুচারু পরিচালনায় তিনটি উৎসবই খুব সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড়া চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রথম জাতীয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব তাঁর নেতৃত্বে যথেষ্ট জাঁকজমক দু’টি উৎসবে পরিণত হয়। মূলত তাঁর উদ্যোগে চট্টগ্রামে পরপর দু’বার দক্ষিণ কোরীয় চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বিধানদার আরেকটি বড় গুণ ছিল তাঁর সেন্স অব হিউমার।

যে কোনো পরিস্থিতিতে সবাইকে হাস্যকৌতুকে এবং প্রাণখোলা হাসিতে মাতিয়ে রাখতেন। আবার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে থাকতেন অবিচল। শাসন করতেন তাও হাস্য কৌতুকের মধ্য দিয়ে, কঠিন কিছু না বলে।

বিধানদা ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত নাইজেরিয়াতে ছিলেন সেখানে ক্রস রিভার প্রদেশের রাজধানী কালাবারের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ও টাউন প্ল্যানিং বিভাগে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পর তিনি বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এসময় বিভাগটির জন্যে ন্যাচারাল সিলেবাস প্রণয়ন করেন। এক পর্যায়ে বিধানদা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্বও পালন করেন কিছুদিনের জন্যে। এসব কথা সচরাচর তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধতায় তেমন কাউকে বলতেন না। শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তারা এখন বিভিন্ন দেশে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের অনেকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। বছরে দু’মাস ছুটির একমাস কাটাতেন বিশ্বভ্রমণে, অন্যমাসটি দেশে। স্ত্রী ডা. নন্দিতা বড়ুয়া ও দুই পুত্রকন্যা বিপাশা ও অনিরুদ্ধসহ কালাবারেই থাকতেন। কন্যা ও পুত্রের জন্মও সেখানে। ওরা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। চিকিৎসক স্ত্রী নন্দিতা সহধর্মিনী ও চিকিৎসক দুইভাবেই সফল ভূমিকা পালন করে গেছেন। বিধানদা জীবনের শেষ দশকটি অসুস্থতায় কাটিয়েছেন। নন্দিতা বৌদি ছায়ার মতো তাঁর পাশে ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৫ মে থেকে এই অন্তরঙ্গ ও পরস্পর নির্ভর দাম্পত্য অক্ষুণ্ন ছিল ২০২৫ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫২ বছর।

বিধানদা ছিলেন অত্যন্ত অন্তর্মুখীন একজন মানুষ। নিজের ও পরিবার সম্পর্কে কিছুই বলতেন না। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে দেশে ফেরার পরে বিদেশে অনেক সুযোগ পেয়েও আর যাননি। রয়ে গিয়েছিলেন নিজের শহরেই। আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক (৩৭ বছরের, ১৯৮৮ সাল থেকে), যা পারিবারিক স্তরে উপনীত হয়েছিল, তার কারণে কিছু তথ্য জানবার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর আন্তরিক সান্নিধ্য এ আমার নগণ্য জীবনের এক অপরূপ অধ্যায়; যা কখনো জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার, কখনো পিতার, কখনো বন্ধুর, কখনো বা অভিভাবকের। তবে বন্ধু প্রতিম অভিভাবকের সম্পর্কইটা ছিল মুখ্যবয়সের দীর্ঘ ব্যবধানকে অতিক্রম করে। নিশ্চিত ও নিবিষ্ট মনে সব কথা বলা যেত যাঁর সঙ্গে সে মানুষটি হারিয়ে গেলেন। আমি আরও নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। নিঃসঙ্গ হলাম আমরা অনেকে।

১৯৪৬ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কোটেরপাড় গ্রামে তাঁর জন্ম। দীনবন্ধু বড়ুয়া ও ননীবালা বড়ুয়ার ছয় পুত্রের তৃতীয় জন বিধান। স্পষ্টবাদী মানুষটিকে অনেকে সমীহ করে দূরে রাখলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত দিলখোলা ও প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। ৭৯ বছরের দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো ২০২৫ সালের ৬ মার্চের রাতের প্রথম প্রহরে আকস্মিকভাবে, আগাম কোনো সংকেত না দিয়ে। এ শহরের, এ দেশের অনেক মানুষ তাদের প্রিয় মানুষটিকে অনেক অনেক দিন মনে রাখবে। ভালোবাসবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকথায় ও স্মৃতিচারণে খালিদ আহসানকে স্মরণ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে আইকিউএসির কর্মশালা