চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সারা বিশ্বের আলোচ্য বিষয় বর্তমান সময়ে। উন্নত বিশ্বের জন্য তো বটেই অনুন্নত দেশগুলোর জন্যেও একটা আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক কন্টেন্ট। সেই অর্থে আমরা এখন চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি। সাধারণ অর্থে, বিদ্যমান সময়ের সাথে প্রযুক্তি বিকাশে নিত্যনতুন কৌশলগত ধারণা–ই চতুর্থ শিল্প
বিপ্লব। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে সামনে রেখে। যে দেশ বা সমাজ মানস এ–ই বস্তুগত ধারণা অবলম্বন থেকে পিছিয়ে থাকবে সে দেশ অপরাপর আধুনিক রাষ্ট্র থেকে পিছিয়ে থাকবে। আমরা এখন জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃথিবীতে বাস করছি। আমাদের মুক্তি ও যুক্তি জ্ঞান–বিজ্ঞান–ই সমাধান দেবে। এই
জ্ঞানবিজ্ঞানে প্রযুক্তি বিকাশ ও ব্যবহার–ই হবে একমাত্র মাধ্যম। অর্থাৎ আমাদের বিশাল মানব সম্পদকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে নিত্যনতুন প্রযুক্তি পরিভাষা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। যদি তা করতে ব্যর্থ হই, সব রকমের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। পরিবর্তিত উচ্চতর সময় চাহিদার সাথে চলতে ব্যর্থ হলে বৈষম্য বৃদ্ধি
পাবে। সারা দুনিয়া একসাথে এগুতে থাকলে অন্যান্য অনুন্নত দেশ – রাষ্ট্রকে সমান ১০০% না হোক কমপক্ষে ৭০% অথবা ৮০% এগিয়ে থাকতে হবে। নচেৎ বিশ্ব স্ট্যান্ডার্ডে পিছিয়ে পড়ব অজ্ঞতায় এবং অভিজ্ঞতায়। একবিংশ শতাব্দী বড় একটা চ্যালেঞ্জিং সময়। এ–ই সময়টা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের চরম উৎকর্ষের সময়। অর্থকড়ির চেয়ে বুদ্ধির কড়ি দিয়ে আন্তঃসম্পর্ক বুনন ও আধিপত্যবাদ নতুনরূপে কায়েম হবে।
তৃতীয় বিশ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞান যে মাসলম্যান অস্ত্র বাজির দৌরাত্ম নিয়ে ক্ষমতার দিকে ছুটতে থাকে কিছু সংখ্যক অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতার আস্ফালনে; সেটি সামনের পরিব্যাপ্ত সমাজ কাঠামোতে আর অবশিষ্ট থাকবেনা। কারণ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর ভেতরে প্রবেশ করতে হলে জ্ঞানবিজ্ঞানে ও
প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তুর জ্ঞান থাকাটা বাঞ্চনীয়। যতই দিন যাচ্ছে আমাদের উন্নততর প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়ছে। সরকারের মিশন ও ভিশন হচ্ছে একটা ডিজিটাল বাংলাদেশ। সে–ই লক্ষ্যে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। ডিজিটাল বাংলাদেশ – এ কথাটি প্রথম আলোচনায় আসে ২০০৮ সালে। সম্ভবত ২০০৯
সাল অথবা ২০০৮ সালের ১২, ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথাটি গুরুত্ব সহকারে বোঝানোর চেষ্টা করেন। আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে কতটুকু নির্ভরশীল হবে, সে বিষয় বিশদ আলোকপাত।
মূলত ৪টি মূলস্তম্ভ ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপবেখা প্রণয়ন করা হয় ; মানবসম্পদ উন্নয়ন, ইন্টারনেটর সংযোগ স্থাপন, ই প্রশাসন, এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পখাত গড়ে তোলা। এ–ই কর্মযজ্ঞে দেশের অর্জনও কম হয় নি। ডিজিটাল সেবাখাতের আওতায় বেশ কিছু কাজ হয়েছে। এ–ই ডিজিটাল কর্মযজ্ঞের একটা অংশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটা বড়ো অনুচ্ছেদ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বইয়ের লেখক অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াব একজন জার্মান প্রকৌশলী ও বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং তিনি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সভাপতি। অগ্রগামী প্রগতিশীলতা আগামী মানবসভ্যতার ওপর কতখানি প্রভাব ফেলবে এবং মেধা ও মননে রূপান্তরিত মানবসভ্যতা প্রযুক্তি
ব্যবহারে কতটুকু সফল হবে ; এই নিয়ে ক্লাউসের চর্চা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এ–ই বিষয় নিয়ে প্রথম আলোচনার সূত্রপাত হয় জার্মানিতে সম্ভবত ১৯১১ সালে।
আমার আজকের উল্লিখিত বিষয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত জ্ঞান ও প্রস্তুতি। ডিজিটাল বাংলাদেশকে সম্মুখে রেখে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তা হলো ; ক) কানেক্টিভিটি ও আইসিটি অবকাঠামো খ) মানবসম্পদ উন্নয়ন গ) আইসিটি শিল্পের উন্নয়ন ঘ) ই – গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য।
আমাদের বিশাল জাগরণ ঘটেছে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে ব্যবহার। ধীরেধীরে অপারেটিং সিস্টেম ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ডেভেলপ করছে। এই যে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আমরা লক্ষ্য করছি তা না হলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কোনো ঘাটকে আমরা ছুঁতে পারবো না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণা আমাদের জন্য বড়
একটা চ্যালেঞ্জ পঞ্চম শিল্পবিপ্লবে পৌঁছানো। একথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে পূর্বের তিনটি শিল্পবিপ্লবের ফলে। এক, ১৭৮৪ সালে পানি ও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নানাবিধ ব্যবহার ও কৌশল অবলম্বন। দুই, ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন চিত্র পুরো
পাল্টে যায়। মানুষের যন্ত্রনির্ভতার কারণে শারীরিক পরিশ্রম কমে যায়। এরপর ইন্টারনেট ব্যবহারের তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। আমাদের জ্ঞানের জগতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে। বাংলাদেশে মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মেট্রোরেল, সাইবার প্রযুক্তি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও অনাগত পঞ্চম শিল্পবিপ্লব
সম্পর্কিত এক্সপেক্টশন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গত ১১ বছর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা কম থাকাতে কিছু উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা সবল ও সক্রিয় থাকলে উন্নয়ন প্রকল্প দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হতে পারে। একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী হলে ভাটা পড়ে। সে ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন বেশি না হলেও
একেবারে কম হয়নি। চলমান উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। কর্ণফুলী টানেল সেতু, এবং ভবিষ্যতে কক্সবাজার টেকনাফ হয়ে বার্মার সাথে যুক্ত হয়ে ট্রান্স এশিয়ান নেটওয়ার্ক সৃষ্টি, বন্দরের অর্থায়নে সীতাকুণ্ড বে টারমিন্যাল, নির্মাণ এগিয়ে যাচ্ছে। দুই বন্দরের আধুনিকায়নসহ ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের
কাজ সবসময় চলমান। এরইমধ্যে যুগান্তকারী ঘটনা পদ্মাসেতু নির্মাণ নিজস্ব অর্থায়নে সম্পূর্ণ করা। পদ্মাসেতু করে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের সময় সহজ করে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের রূপকল্পের এখন তিনটি সূত্র ; স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার। জ্ঞানে – বিজ্ঞানে এবং প্রযুক্তিতে
স্মার্ট হতে হবে। এই তিনের একত্রকরণে কাজ করবে স্মার্ট ডিজিটাল সংযোগ। তিনের সংমিশ্রণ যদি সাধুসঙ্গ হয় তাহলে নতুন এক ডিজিটাল দেশ তৈরি হবে, যা আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন ও নির্মাণের স্মারক। সরকার প্রধানের চেষ্টা কমতি নেই। তিনি ভাবনাকে বিজ্ঞানে রূপান্তর করতে অস্থির হয়ে ওঠেন। যেমন ২০১৮
সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট – ১ কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করেছে, যা সমপ্রচার ও টেলিযোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তার–ই ধারাবাহিকতায় স্যাটেলাইট ২ স্থাপনের পদক্ষেপ চলছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের মধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল। এরইমধ্যে দেশ ৩ হাজার
৪০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপিত হয়ে গেলে ১৩ হাজার ২০০ জিবিপিএসে উন্নীত হবে। ভবিষ্যতে উদ্বৃত্ত ব্যান্ডউইথ লিজ দেয়ার মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। বর্তমানে মালেশিয়া ফ্রান্স ভারত ও সৌদি আরব –কে লিজ দেয়ার মাধ্যমে দেশ প্রতিবছর ৪
দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশ এখন মোকাবিলা করছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত যাবতীয় কঠিন ধাপ। যতই সমালোচনা করা হোক বা যে ভাবে করা হোক আমাদের ডিজিটালাইজেশনের বিকল্প নেই। অতএব সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি পদ্ধতিগত শিক্ষা ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে বেশি। উৎপাদিত
কৃষি জমি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বারোমাস যাতে ফলনমুখো রাখা যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র আবিষ্কার করে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করা। জনগণের জন্য কর্মমুখী ও নিত্যনতুন খাতে কর্ম পরিবেশ গড়ে তোলা। এগিয়েই যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। বিদেশীদের বিনিয়োগে এগিয়ে
আসার আহবান জানানো হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত বিষয়ের প্রাথমিক শর্ত স্মার্ট নাগরিক জ্ঞান যন্ত্রব্যবহারে। উন্নত নাগরিক সংস্কৃতিবোধ নির্মাণও হতে পারে অন্যতম বৈশিষ্ট্য । অদক্ষতা ও অশিক্ষা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ কখনোই সম্ভব না। কেবল সম্ভব হতে পারে মানব সম্পদের
যথাযথ ব্যবহারে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা হলে। সরকারি বাজেটের বড়ো বরাদ্দ রাখতে হবে এ–ই লক্ষ্য –কে সামনে রেখে। দরকার শুধু ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে দলমত নির্বিশেষে একটিই সিদ্ধান্ত এবং প্রতিজ্ঞা তা হলো যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি করা চলবে না। কারণ,
ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরায় তুলে নিতে প্রচুর অর্থ ঋণ করতে হয়। সর্বদা ঋণের ভারে জর্জরিত দেশ বিশ্বের তুলনামূলক অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিতে পারে না কখনো। করের বোঝা শেষ পর্যন্ত জনগণের মাথায়ই চাপে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মুভমেন্ট চলুক কিন্তু তা জানমালের ক্ষতি করে নয়, নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলুক।
মোদ্দা কথা, একটা শক্ত জবাবদিহি সরকার ব্যবস্থা চালুসহ রাষ্ট্রের প্রত্যেক অর্গানকে সক্রিয় ও নিরেপক্ষ স্বাধীন করতে পারলে স্মার্টসিটিজেশীপ অর্জন করা কঠিন কিছু হবে না। আমাদের প্রয়োজন স্মার্ট বাংলাদেশ এবং স্মার্ট সিটিজেন। লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট