আমাদের পাঠ্যসূচি ও অবহেলিত বিজ্ঞানের ইতিহাস

অনুপ দাশগুপ্ত | সোমবার , ২৬ মে, ২০২৫ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

বিজ্ঞান কি সাহিত্য? অনেকেরই মনে প্রশ্ন। তবে এই প্রশ্নটি বহুদিনের পুরনো। বিজ্ঞানের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি একটা সাহিত্য। ঠিক কবিতার মতো। বিখ্যাত রোমান্টিক কবি জন কিটস কবিতা সম্পর্কে তাঁর প্রকাশক জন টেইলরের কাছে এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘গাছের পাতা যেমন প্রাকৃতিক উপায়ে জন্ম নেয়, কবিতারও তেমনই স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিতে হয়, নতুবা সে কবিতার না আসাই ভালো। কল্পনা থেকে যেমন কবিতার জন্ম হয়, বিজ্ঞানও গাছের পাতার জন্ম রহস্য উদ্ঘাটন করে কল্পনার জাল ছড়িয়ে’। আবার জন কিটস তাঁর ‘ওড টু নাইটিংগেল’ এ বুলবুলির গানকে বলেছেন ব্যথানাশক, বলেছেন সে গান সুন্দর, কারণ তাতে মানবজীবনের যন্ত্রণা নেই। কল্পনা শক্তিকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন কবিতা সৃষ্টির পিছনে। ঠিক বিজ্ঞানের সৃষ্টিতে যেমন কল্পনা শক্তির প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ঠিক তেমনি কবিতার প্রধানতম উপাদানও হলো কল্পনার বিজ্ঞান। যেমন জন কিটস তাঁর কবিতার বই ‘লামিয়া’তে বলেছিলেন, রংধনু তৈরি হওয়ার কার্যকারণটি জেনে ফেললে যেমন বিজ্ঞান জানা যায়, তেমনি কবিতায় রংধনুর উপমা ব্যবহারেও বিজ্ঞান সাহিত্যের প্রয়োজন। আসলে বিজ্ঞান এবং সাহিত্য দুটোই পাশাপাশি চলে, যেখানে সৃষ্টিতে লাগে প্রবল কল্পনার উন্মেষ। বিজ্ঞানের কনিষ্ঠতম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী উইলিয়াম লরেন্স ব্রাগও সাহিত্য আর চিত্রকলার ভক্ত ছিলেন। তাইতো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন ক্যাটলফিশের এক নতুন প্রজাতি। তাঁর নামেই যার নাম রাখা হয় সেপিয়া ব্রাগি! সাহিত্য যেমন সংবেদনশীল মনন তৈরী করে, বিজ্ঞান তেমন আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে কল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে মানব কল্যাণে নতুন নতুন কিছু আবিষ্কার করে। আজকের আলোচনার বিষয় হলো আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্কুলে বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদেরকে কতটুকু কল্পনা প্রবণ ও সৃজনশীল করে তুলছে? বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে ঠুনকো মনে হলেও, এর গভীরতা কিন্তু অনেক। বিজ্ঞানের বর্তমান পাঠক্রম অনেকটাই অবহেলিত ও দারুণভাবে উপেক্ষিত। আমি অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে প্রচণ্ড কৌতূহল আছে। তারা জানতে চায়। তাদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ আছে। কিন্তু আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনগুলো এমন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনোরকম কৌতূহল সৃষ্টি করে না। ফলে যাঁদের মধ্যে কৌতূহল আছে, তাঁরা নীরবে ঝরে পড়েন। শুধু বিজ্ঞান বিষয়টাকে বোরিং ভাবে পড়ানোর কারণে। মুখস্থ নির্ভর এই বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রম কোনোভাবেই শিশু কিশোরদের মননে কল্পনা শক্তি ও কৌতূহলের উদ্দীপনা তৈরী করতে পারছে না। কেন এমন হলো? কিছু কারণ আমার মতো করে ব্যাখ্যা করতে চাই, আমার অভিজ্ঞতা ও ধারণা থেকে। প্রথম কারণ হলো, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ দেশে চাকুরির সুযোগ অনেক কম। ফলে অনেকেই এসব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে উৎসাহবোধ করেন না। তার উপর রয়েছে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক শিক্ষাগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে শিক্ষকদের পড়ানোর যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার স্বল্পতা। নেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এসবের কারণে শিক্ষকরাই যেখানে পিছিয়ে থাকে সেখানে শিক্ষার্থীদের কথা আর নাইবা বললাম। ফলে পরবর্তী সময়ে এমন মনোভাব তৈরী হয়, তাঁরা মনে করেন, কসমোলজি, আইনেস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব, রবার্ট পেনরোজ, স্টিফেন হকিংয়ের কথা শুনে উল্লাসিত বোধ করেন, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় যাওয়া যাবে না।

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটা এমন যে কোনো শিক্ষার্থীই তাঁর পছন্দের বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রে পড়ার সুযোগ পান না। এরপরও বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহীদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ পায় মাত্র। বিজ্ঞানের প্রতি কোনো আগ্রহ আসলে এখানে কাজ করে না। যাঁরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান, তাঁদের মধ্যে আগে থেকে মানসিক কোনো প্রস্তুতি থাকে না। এরপর কখনো কখনো পড়তে পড়তে কোনো বিষয় ভালো লেগে যায়। শিক্ষার্থীরা মজা পেয়ে যান, কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার প্রক্রিয়াটি এমন, সেই মজাটা তুলে আনা কঠিন ব্যাপার। এ বিষয়ে বহুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিখ্যাত প্রফেসর ড. এখলাস উদ্দীন স্যার বলেছিলেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের অনেক বিষয় আছে। কিন্তু এর সঙ্গে একটি বিষয়, ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক বিজ্ঞান শিক্ষার্থীকে পড়তে হয়। বিজ্ঞানের ইতিহাস হচ্ছে, প্রতিটি আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের পেছনের যে সুখদু:খ ও সামাজিক কার্যকারণ বিরাজমান থাকে, এর বর্ণনা এবং বিশ্লেষণকে তুলে ধরা। তখন একজন বিজ্ঞান শিক্ষার্থী বুঝতে পারেন এই আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, আমাদের মতোই তাঁদের হাসিকান্নার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পার্থক্য শুধু অভিজ্ঞতাকে বিশেষ দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখা। তিনি তখন বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল নৈকট্য অনুভব করেন। তখন জায়গাটি তাঁর কাছে খটখটে বিষয় থাকে না, নিজেকে উম্মোচনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের দেশে স্কুল কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যপুস্তক ও পাঠক্রমে বিজ্ঞানের ইতিহাসের উপর কোনো বিষয় নেই। আবার যারা এসব বিষয়ে পাঠক্রম তৈরী করেন তাদের মনোভাব এমন, বিজ্ঞানই ঠিক মতো পড়ানো হয় না, আবার সেখানে বিজ্ঞানের ইতিহাস ! এ আবার কী ! ফলে আমাদের দেশে বিজ্ঞান কতগুলো তত্ত্ব মুখস্থ করা অথবা যন্ত্র উদ্ভাবন ছাড়া আর কিছুই নয়। একেবারেই একটি নিরেট টেকনিক্যাল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে চাকুরি পাওয়ার হাতিয়ার ছাড়া আর কোনোভাবে এটাকে শিক্ষার্থীরা বিবেচনা করেন না। এর ফলে না থাকে এর প্রতি আগ্রহ, আর না থাকে ভালোবাসা। অথচ শিক্ষার মূল কাজ হচ্ছে সেই ভালোবাসা, সেই আবেগঅনুভূতি সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তোলা। সেই মানবিক বোধগুলোর বিকাশ ঘটানো, যার দ্বারা সমাজের অন্য আর দশজনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারা।

দ্বিতীয়ত, তাঁকে সৃজনশীল ভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করানো যাতে নিজের জায়গাটি খুঁজে নিতে পারেন। চিন্তা দিয়ে, কাজ দিয়ে সমাজে অবদান রাখতে পারেন। এ কাজটি ‘ বিজ্ঞানের ইতিহাস’ সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে।

চরম দুর্ভাগ্যজনক হলো, শিক্ষাকে আমরা ভালো চাকরির অস্ত্র হিসেবে দেখেছি। জি পি এ এবং স্কোরের প্রবণতা নিয়ে কোনো রকম বোঝাপড়া ছাড়া একজন শিক্ষার্থীর একের পর এক ক্লাস টপকানো কোনো মানবিক বোধ তৈরিতে সার্মথ্য হয় না। ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ না পড়ার কারণে জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে হয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষকদের মারাত্নক অনীহা সৃষ্টি হয়।

কিছুদিন আগে ইউরোপের এক সমীক্ষা সংস্‌হার পরিসংখ্যান রিপোর্টে জানা যায়, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, প্রায় পাঁচ গুণ এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় দ্বিগুণ হারে এই বৃদ্ধি হয়েছে। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রতি এরকম চরম হতাশা জনক চিত্রের জন্য শিক্ষক যেমন দায়ী। তেমনি দায়ী হলো যারা পাঠক্রম তৈরি করেন তাদের অজ্ঞতা। কিন্তু এও সত্য, একজন ভালো শিক্ষকের গড়ে ওঠার পেছনে সামাজিক মূল্যায়নও হতাশাজনক। আর আমাদের সংস্কৃতিতে রয়েছে বিজ্ঞানকে গ্রহন না করার প্রবণতা। বিদেশি জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের আকর্ষণ নেই, রয়েছে বিদেশি অর্থের প্রতি লোভ। তখন ধনী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে এ ধরণের মানুষদের দিয়ে গরিব দেশগুলোর ওপর তাদের উদ্দেশ্যকে চাপিয়ে দেয়। টেঙট বইয়ের উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কিন্তু বিদেশিদের অর্থ দেওয়ার কারণে তাদের হস্তক্ষেপ নানাভাবে হয়, যা বন্ধ করা যায় না।

সবকিছু থেকে এটা পরিষ্কার যে বিজ্ঞানের সৃষ্ট প্রযুক্তিকে ব্যবহারে প্রবণতার বৃদ্ধি ছাড়া বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের কৌতূহল ক্রমেই কমছে। বিজ্ঞানকে সবকিছু করে দেওয়া যাদুর যন্ত্র হিসেবেই সবাই দেখছে, যা ভোজবাজি ঘটিয়ে কিছু একটা করে দেবে। অথচ বিজ্ঞান হচ্ছে যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তৈরি একটি প্রক্রিয়া। ফলে বৈজ্ঞানিক মানসিকতার বিকাশ ঘটছে না।

একজন শিক্ষার্থীর সামনে বিজ্ঞানের সত্য এবং ধর্মের বিশ্বাসকে শিক্ষার প্রারম্ভে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে এ দুটি বিষয় তার কাছে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু এ দুটির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি বিশ্বাস স্থাপন। আরেকটি হলো যুক্তি ও অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণের সমন্বয়। আবার শিক্ষার্থীকে চার্লস ডারউইনের ও রাসেল ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন পড়ানোর সময় বলা হয় ‘বিশ্বাস করো না’। তখন কিশোর মনে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়। শিক্ষার্থীর মনে যৌক্তিক বোধগুলোর বিকাশ ঘটতে পারে না। এই প্রতি বিপরীত পরিস্থিতিগুলোও একধরনের অনীহা তৈরি করেছে। এই প্রতিবিপরীত বিষয়গুলো থেকে বের হতে না পারলে আমাদের সমাজে বিজ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটবে না।

এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ হলো ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ পড়ানো। যাতে বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি তত্ত্ব উপস্থাপন করার সময় তার পেছনের ইতিহাসটা তুলে ধরতে পারলে বিষয়টা শুধু বোঝাই সম্ভব হয় তা নয়, একধরনের অস্বস্তিকর পিরিস্থিতি থেকে মুক্তি ঘটে। আমাদের মনে রাখতে হবে বিজ্ঞান হচ্ছে মহাবিশ্বকে বোঝা, মহাবিশ্বের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক অনুধাবন করা। বিজ্ঞানের ইতিহাস হচ্ছে সেই অনুধাবনকে সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া। নিজের দেশের পলিমাটির সঙ্গে বিজ্ঞানকে আত্তীকরণ করে না দেখতে পারলে বিজ্ঞানের বিশ্বজনীন ব্যাপারকে অনুবাধন করা সম্ভব হবে না। তাই তো আমাদের কবি গুরু আজ থেকে ১০২ বছর আগে ‘বিশ্বপরিচয়’ নামের অসাধারণ একটি বিজ্ঞান গ্রন্থ লিখেছিলেন। এবং তাঁর গানেও তিনি লিখেছিলেন, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো সেই খানে যোগ তোমার সাথে আমারও’। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ইতিহাসকে সর্বজনীন দৃষ্টিতে কৌতূহলী ও আনন্দদায়ক পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে পড়াতে না পারলে, এই অবস্থার পরিবর্তনের আশা, দুঃস্বপ্নই থেকে যাবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেমের কবি নজরুল
পরবর্তী নিবন্ধআত্মপরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়