২৫ শে মার্চ কালো রাতে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী দেশের নিরীহ মানুষের ওপর ক্রাক ডাউন শুরু করে তখন একরাতে হাজার হাজার মানুষ আহত ও নিহত হয়। হানাদার বাহিনীর হঠাৎ আক্রমণে নিরীহ জনগণ হতচকিত হয়ে পড়ে। পরে ২৬ ও ২৭শে মার্চ দেশের অনেক এলাকায় বিশেষ করে ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বিদ্রোহ দেখা দেয়।
সেই বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় ২৭শে মার্চ সকালে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে কুমিল্লা ক্যন্টনমেন্টের চতুর্থ বেঙ্গলে যে সফল বিদ্রোহ ঘটে, লেফটেন্যান্ট ডা. আখতার তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিদ্রোহ শেষে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বিদ্রোহের পুরস্কার হিসেবে ডা. আখতারকে তিনি তৎক্ষণাৎ ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি দেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন আখতার মেজর খালেদের সঙ্গে পরামর্শ করে কুমিল্লা সীমান্তের কাছে আগরতলার শ্রীমন্তপুর এলাকায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নেন। হাসপাতালের জন্য কোনো স্থাপনা না পাওয়ায় তিনি একটি গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে ইটের ওপর কাঠের তক্তা বসিয়ে বিছানা বানিয়ে হাসপাতালের প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে সেই ইট বিছানো হাসপাতালই রূপান্তরিত হয়ে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল বা বাংলাদেশ হাসপাতাল নামে পরিচিতি লাভ করে। যা ছিলো অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একমাত্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কারী প্রতিষ্ঠান।
অন্য দিকে একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে ডা. নাজিম কর্তব্যরত ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। ২৭ মার্চ ময়মনসিংহে ইপিআরে আক্রমণ এবং পুলিশ লাইনস থেকে অস্ত্র লুটের ঘটনায় অংশ নেন ডা. নাজিম। ২৯ মার্চ চিকিৎসকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ক্যাপ্টেন নাসিম (পরে সেনাপ্রধান) এবং আর্মি মেডিকেল কোরের লেফটেন্যান্ট ডা. মোকতার কামাল চৌধুরী আসেন ময়মনসিংহ মেডিকেলে। তাঁদের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ডা. নাজিম পরবর্তী সময়ে আগরতলায় গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। তিনি সেখানে পৌঁছানোর পর সীমান্ত এলাকা বিবির বাজারে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। সেই আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে আগর তলার সোনামুড়ায় ডা. নাজিম একটি বাংলোয় অস্থায়ী হাসপাতাল বানিয়ে চিকিৎসা দিতে থাকেন।
অন্যদিকে শ্রীমন্তপুরে গোয়ালঘরে হাসপাতাল পরিচালনা করতে থাকা ডা. আখতার পাকিস্তানি আক্রমণে বাধ্য হয়ে পিছু হটে সোনামুড়ায় চলে আসেন। এরপর ডা. নাজিম আর ডা. আখতার যৌথভাবে এ হাসপাতাল চালাতে থাকেন। একসময় স্থানীয় বন বিভাগের সঙ্গে দেন দরবার করে হাসপাতালটিকে তাদের একটি টিনের ঘরে স্থানান্তর করেন। ডা. আখতার ২ নম্বর সেক্টরের সেনা অফিসার থাকার কারণে পদাধিকারবলে হয়ে যান হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার, তবে মূল কাজ চালাতেন ডা. নাজিম। সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানিদের আক্রমণ বেড়ে গেলে একপর্যায়ে বাংলাদেশ হাসপাতাল আরো খানিকটা ভেতরে সরিয়ে সেক্টরের মূল কার্যালয়ের কাছে মেলাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে হাসপাতালের সাংগঠনিক শক্তি আরো মজবুত হয়। এ সময় এতে নার্সিংয়ে নিয়োজিত অন্যদের সঙ্গে এসে যোগ দেন কবি সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাহিদা কামাল, স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহর পরিবার এবং অন্যান্যরা। একাত্তরের মে মাসের দিকে এই মেলাঘর হাসপাতালে ইংল্যান্ড থেকে এসে যোগ দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. এম এ মোবিন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরের প্রতিটির হেডকোয়ার্টারের সঙ্গেই একটি করে মেডিকেল ইউনিট ছিল। জনবল ও যন্ত্রপাতির দিক থেকে সব সেক্টরের মেডিকেল স্থাপনা সমান ছিল না। কেবল ২ নম্বর সেক্টরের মেডিকেল স্থাপনা ছিল সদর দপ্তর থেকে খানিকটা দূরে। অনেকটা স্বতন্ত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থাপনার মতো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আহতদের জটিল ও সমন্বিত চিকিৎসা দেওয়া হতো মূলত ভারতীয় কোনো হাসপাতালে। তবে স্বতন্ত্রভাবে সম্পূর্ণ বাংলাদেশি জনবল ও অর্থায়নে পরিচালিত ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নামে পরিচিত এই চিকিৎসা কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের আইকনে পরিণত হয়।
লন্ডন থেকে এসেই ডা. মোবিন হাসপাতালের কাজে নেমে পড়েন আর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি যুক্ত হয়ে পড়েন হাসপাতালটির সমপ্রসারণ এবং বাংলাদেশি ডাক্তার–নার্স দিয়ে সেটি পরিচালনা করার পরিকল্পনায়। মেজর খালেদ মোশাররফ কলকাতায় গিয়ে প্রবাসী সরকারের কাছে এই নতুন হাসপাতালের প্রস্তাব পেশ করে ৫ হাজার টাকা বরাদ্দের জন্য অনুরোধ করলে তারা ৫০ হাজার টাকা অনুমোদন দেয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ইউকে থেকে প্রাপ্ত অর্থও এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় খরচ করা হয়। এর পর নতুন হাসপাতালের জন্য আগরতলার আরো ভেতরে বিশ্রামগঞ্জ এলাকায় হাবুল বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজনের লিচু বাগানকে স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। লিচুগাছ না কাটার শর্তে হাবুল বন্দ্যোপাধ্যায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিলে সেখানে বিভিন্ন বিভাগসহ একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত তিন জন প্রকৌশলী নূরুল হুদা, তাজুল ইসলাম ও মাহবুবুল হক হাসপাতালের কাজ তদারকি করতে আসেন। এ ছাড়া ক্র্যাক প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলমের বাবা প্রকৌশলী হাফিজুল আলম নিযুক্ত হন হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে। অবশেষে ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ হাসপাতাল মেলাঘরের দারোগা বাগিচা থেকে বিশ্রামগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দেন আর্মি মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম। ডা. আখতার তখন বাংলাদেশ হাসপাতালের কমান্ড্যান্ট হলেও প্রায়ই নানা সাবসেক্টরে তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে হতো।সে কারণে ডা. সিতারা এলে অক্টোবরে তাঁকে বাংলাদেশ হাসপাতালের কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডা. সিতারা পরবর্তীতে বীর প্রতীক উপাধি পান।
যুদ্ধের সময়টিতে ডা. জাফরুল্লাহ মূলত সক্রিয় ছিলেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে হাসপাতালের জন্য অর্থ, যন্ত্রপাতি, ত্রাণ এবং মুক্তিযোদ্ধা দের জন্য বিভিন্ন উপকরণ জোগাড় করার কাজে। তবে ফিল্ড হাসপাতালের ওষুধ জোগাড় করা ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ। এক হাতে চিকিৎসা করা, অন্য হাতে ওষুধ সংগ্রহ আর সেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সব সময় দৌড়ের ওপর থাকতে হতো। এরমধ্যে তিনি খবর পান, মানবিক সাহায্য সংস্থা অঙফামের কাছে বিদেশ ও ভারতের নানা সূত্র থেকে ওষুধ এসে জমা হয়েছে। তিনি দ্রুত কলকাতা ছুটে যান। কলকাতা অক্সফাম অফিসের দায়িত্বে থাকা জুলিয়ান ফ্রান্সিস ওষুধের জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সেই হন্যে হয়ে ছুটে আসাকে ‘হানা‘ বা রেইড বলে আখ্যায়িত করেন।
মানবিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম সাথি সংস্থা বা পার্টনার প্রতিষ্ঠান ছাড়া কাজ করে না। কিছু নীতিমালা মেনে একটা চুক্তির ভিত্তিতে সহযোগিতা করে থাকে। তারা সরাসরি যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক এড়িয়ে চলে। কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সেই কথিত ‘হানা’র ফলে অঙফাম শেষ পর্যন্ত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে জুলিয়ান ও জাফরুল্লাহর বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়েছে। কিন্তু জাফরুল্লাহ সেই বন্ধুত্বের জোয়ারে গা ভাসিয়ে চোখ বন্ধ রাখেননি। বিদেশি সংস্থার নানা পদক্ষেপকে বরাবর চ্যালেঞ্জ করেছেন।
বাংলাদেশ হাসপাতালের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে যে কয়েকজন চিকিৎসকের নাম বিশেষভাবে জড়িত তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. এম এ মোবিন, ডা. আখতার আহমেদ, ডা. নাজিমুদ্দীন আহমেদ ও ডা. সিতারা বেগম। তবে অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ হাসপাতালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তখন সেখানে ছয়জন ডাক্তার, চারজন মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্র এবং ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবী নার্স কর্মরত ছিলেন। আর এসব দেশপ্রেমিক ও নিঃস্বার্থ মানুষের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নামে একটি অন্যন্য হাসপাতাল। যা আমাদের গর্বের প্রতীক।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।