আমাদের আব্বা এডভোকেট বদিউল আলম এর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু স্মৃতি কথা

হুরে জান্নাত | শুক্রবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, আমাদের আব্বা এডভোকেট বদিউল আলম সাহেবের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি চট্টগ্রামের একজন খ্যাতনামা আইনজীবি, সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯২৬ সালে চন্দনাইশ উপজেলার ফতেহনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেন।

১৯৯৭ সালে আব্বার সম্মানে প্রকাশিত “নন্দিত’’ নামক স্মারক গ্রন্থে আব্বার শিষ্য এ.এম, আনোয়ারুল কবীর লিখেছেন “এই দীর্ঘ জীবনের এমন এক লগ্নে তিনি পৌঁছেছেন, যখন তিনি একজন পরিপূর্ণ মানুষ, অনেকগুলো ফল তার শাখাপ্রশাখায় ধরে আছে। তিনি সেটার ভারে একটু নূয়ে গেছেন। এই হচ্ছে তাঁর পরিচিতি”। পেশাগত উৎকর্ষিতায় তিনি শুধু নিজেকে এককভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন নি বরং তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন শতাধিক আইনজীবী। তারা সবাই হচ্ছেন এখন আব্বার জন্য সদকায়ে জারীয়া।

৬ মাস বয়সে পিতৃহারা, বাড়ীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আব্বাকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন উনার জেঠাত ভাই নজীর উদ্দিন আহমেদ ও আপন ভাইরা। একান্নবর্তী পরিবারে কেটেছে ওনার শৈশব। ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এই বাক্যটি যথাযথভাবে প্রযোজ্য আমাদের আব্বাজেঠাদের “শিকদার বাড়ী”। মা, জেঠীরা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সহযোগিতার আদর্শ ধারণ করে সংসার করেছেন। কথায় বলে “একটি খারাপ আপেল ঝুড়ির সব আপেলকে নষ্ট করে দেয়’’পরিবারের কোন সদস্যের খারাপ আপেলের ছোঁয়া লাগেনি বলে এটি ছিল একটি অসাধারন পরিবার।

তাঁদের যেকোন পারিবারিক ভুল বুঝাবুঝি তারা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করে নিয়েছেন। আব্বা ও তাঁর ভাইদের মধ্যে একতাবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধ কল্পকাহিনীর মত হয়ে থাকবে।

আব্বা বিএ পাস করার পর বেকার সময় নষ্ট না করে বা পৈতৃক সম্পত্তির উপর নির্ভর না করে শুরু করলেন ব্যবসা। সেখানে হলেন চরম ব্যর্থ কিন্তু হাল ছাড়েন নি। বহু চেষ্টার পর কোন রকমে একটা চাকরী জোগার করে চলে গেলেন ভোলায়, কাষ্টম্‌স অফিসার হিসাবে। সেখান থেকে বদলী হলেন বেনাপোল। সেখানেও কাজে তার অনীহা। অবশেষে নানা গোলাম রহমানের (জেলা ও দায়রা জজ) অনুপ্রেরণায় তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নানানানীর তত্ত্বাবধানে রেখে শুরু করলেন ঢাকা

ইউনিভার্সিটিতে ল’ বিষয়ে পড়াশুনা। ল’ পাশ করে যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বারএ। তিনি ছিলেন মরহুম এডভোকেট আব্দুল লতিফের সর্বশেষ ও সর্বকনিষ্ট জুনিয়র । স্বল্প আয়ে পরিবার চালাতে গিয়ে ‘নুন আনতে পানতা ফুরিয়েছে’। তথাপি নিজের আর্থিক সংকট কিছুটা লাঘব করার জন্য পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ আদায় করার চেষ্টা করেননি। ‘সবরে মেওয়া ফলে’আব্বা আম্মার জীবন মূল্যায়ন করতে গেলে উনাদের জীবনে ‘মেওয়াই’ ফলেছে। কারন মাআব্বা ছিলেন পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, সর্বোপরি খোদাভীরু।

পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে আব্বা ও জেঠা দুজনে একত্রে চট্টগ্রামের জামাল খাঁনে একটা ছোট জমি কিনলেন। আব্বার কাছে শুনেছি সেদিনের জামাল খাঁন ছিল টিলা ও জঙ্গলময়, শিয়ালের ডাক শোনা যেত। সেখানে আব্বা একটা বেড়ার ঘর নির্মাণ করে কোনরকমে নিজের পরিবার নিয়ে থাকার জায়গা করে নিলেন। আয় যখন একটু বাড়তে শুরু করল, তখন সে জায়গায় ১৩৪০ বর্গফুটের একটি তিনতলা বাড়ী নির্মাণ শুরু করেন। ‘স্মৃতিকথা’ বইয়ে আব্বা লিখেছেন, “আমার সহধর্মিণীর সহযোগিতা না থাকলে আমাদের পক্ষে পাকা ইমারত করা সম্ভব হত না’’। মনে আছে একটু সাশ্রয়ের জন্য আমরা একবেলা রুটি ও এক বেলা ভাত খেয়েছি। আব্বার সীমিত সাধ্যের মধ্যে ৬১ নং জামাল খাঁন ছিল গ্রামের আত্নীয় স্বজনদের নানাপ্রয়োজনের ঠিকানা। আম্মাও নিপুণভাবে সবকিছু সামাল দিয়ে গেছেন। ‘স্মৃতিকথায়’ আব্বা আরো লিখেছেন, “আমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য আমার চেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার করেছেন আমার স্ত্রী’’। মনে পড়ে এস.এস. সি পরীক্ষার প্রস্তুুতি নেওয়ার সময় গভীর রাত পর্যন্ত মা আমার টেবিলের পাশে বসে খবরের কাগজ বা কোরআন পড়তেন। সারাদিনের সাংসারিক কর্মশেষে নিজের বিশ্রামকে প্রাধান্য না দিয়ে আমাকে সঙ্গ দেওয়াই বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন।

পরিবেশ মানুষকে যা ভাবতে শেখায় সে তাই ভাবে, যা করতে শেখায় সে তাই করে। ব্যতিμমও আছে। এই প্রসঙ্গে আমি আমার ব্যক্তিগত একটা অনুভূতির কথা ব্যক্ত না করে পারছি না। বহুদশক ধরে আমি ও আমার স্বামী (ফজলুর রহমান) লন্ডনের ছোট একটি বাড়ীতে বাস করছি। বন্ধু বান্ধব ও আত্নীয় স্বজনরা আমার স্বামীর নামের সাথে মিল রেখে বাড়ীটির নাম দিয়েছে “রহমানিয়া হোটেল’’। এই বাড়ীতে পড়াশুনার উপযোগী একটা পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা লন্ডনে আগত আত্মীয় স্বজন বা তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করার ক্ষুদ্র চেষ্টা করেছি। অনুরূপভাবে লন্ডনপ্রবাসী আমার আরেক ছোট বোনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। মূলত আব্বা আম্মার মানব সেবার অনন্য গুণাবলী এক্ষেত্রে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। অন্যের কল্যাণে আব্বাআম্মা কখনও হিসাব করেননি। প্রতিটি নেক কাজই ইবাদত, পুরস্কারও অফুরন্ত। মানুষের সেবাকেই তারা দুজনে ইবাদতের অংশ হিসাবে হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। অন্যায় অবিচার, আমানতের খেয়ানত, অন্যের হক বা অধিকারে যারা বাধা সৃষ্টি করে মানবতা বিরোধী কাজ করে শান্তি পায়, যারা আল্লাহর দরবারে তাদের অন্যায় আচরনকে অপরাধ বলে মনে করেনা তাদের নামাজ, রোজা, দানখয়রাত, হজ্জ ও ওমরা পালন কতদূর মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ হবে এর জবাবও পাওয়া যায় কোরান হাদীসে। যা দেখেছি এবং যা তিনি লিখে গেছেন তার উদ্ধৃতি দিয়েই লিখছি।

বিবাদবিসম্বাদ চাই নি, কারো প্রতি বিদ্ধেষ বা বৈরিভাব পোষণ না করে , চলার নীতি অনুসরণ করেছি। এতে ফল হয়েছে শুভ’’।

আব্বাআম্মার সময়নিষ্ঠতা, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ, মহান আল্লাহর বিধান মেনে চলা তাদেরকে মহান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে। সকল স্তরের মানুষকে মানুষ হিসাবে মর্যাদা দিয়েছেন। হোক না সে কাজের লোক, ড্রাইভার, চাষী, কূলি বা শ্রমিক। কাউকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাঁটিয়ে কষ্ট দিতে চাননি। ক্ষমতা জাহির করার জন্য তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করেননি। যাদের দ্বারা উপকৃত হয়েছেন, তাদের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে গিয়েছেন। প্রতিনিয়ত বলেছেন– “শোকর আলহামদুলিল্লাহ’’।

সত্তর দশকের শুরুতে আব্বামা বহদ্দার হাটে কিছু ধানি জমি কিনে ভরাট করে বাড়ী নির্মাণ কাজ শুরু করেন। আব্বা প্রতিদিনের আয়ের ক্ষুদ্র অংশ দিয়ে প্রায় দশ বছর তিলে তিলে অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে ‘শায়ের ৭৬১ নং সি.ডি.এ এভিন্যুর’ ৪ তলা ভবনটি নির্মাণ করেন।

এই বাড়ীটি ছিল আমাদের ছেলেমেয়েদের দাদার বাড়ী/নানার বাড়ী। শায়ের এর সদর দরজা সর্বক্ষণ খোলা থাকত সর্বস্তরের মানুষের জন্য। বন্ধুবান্ধব ও আত্নীয় স্বজনদের সাথে আলোচনায় এই বাড়ীর প্রসঙ্গ উঠলেই সকলেই অকপটে আব্বামাকে ঘিরে তাদের মধুর স্মৃতি কাহিনী ব্যক্ত করে। বহু মানুষের প্রিয় ঠিকানা, বহু স্মৃতি বিজরিত ভবনটি আজ মাটিতে মিশে গিয়েছে, কিন্তু তাদের অন্তরে এই বাড়ীকে কেন্দ্র করে থাকা অজস্র্র মধুময় স্মৃতি থাকবে চিরদিন অমলিন। অনুরূুপভাবে আব্বামার দেয়া চন্দনাইশের বাড়ীর নাম “ইনআম’’ মুছে গেলেও গ্রামের প্রতিটি আনাচে কানাচে আব্বাআম্মার স্মৃৃতিই প্রতিফলিত হবে আজীবন।

প্রতি বছর চট্টগ্রামে গেলে আদালত অঙ্গনে একবার ঘুরে আসিসেখানে ৪০ বছরের উর্ধ্ব সময়কাল ধরে আব্বার ছিল অবাধ পদচারণা। কৃতজ্ঞতা ও গর্ববোধ করি যখন আব্বার স্মরণে চট্রগ্রাম আদালতে উৎসর্গকৃত “এডভোকেট বদিউল আলম স্মারক ব্রীজ’’ টি দেখি।

পরিবার, বংশ ধনদৈৗলত বা সমাজের আপাত প্রশংসা বা স্বীকৃতি নয়নীরবে একনিষ্টভাবে কর্মসাধনা মানুষকে অমর করে। আব্বা আম্মার জীবন সফলতায় পরিপূর্ণ এক অনুকরনীয় জীবন। বহুলোকের স্মৃৃতিতে অনাগত দিনে শ্রদ্ধার সাথে অম্লান হয়ে থাকবে আমাদের আব্বাামা। আমাদের গর্ব আমরা তাঁদের সন্তান। অক্লান্ত কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে আমাদেরকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার সকল দায়িত্ব যারা পালন করে গিয়েছেন। আশা করি পরবর্তী প্রজন্ম তাদের অনুসৃত জীবনাদর্শ ধারণ করার মাধ্যমে এই আলোকচ্ছটার পরিব্যাপ্তি আরও বাড়াবে। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁদের উভয়কেই জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা (লন্ডন), এডভোকেট বদিউল আলমের সর্বজ্যেষ্ঠ কন্যা, ২০২৩

পূর্ববর্তী নিবন্ধছোট বা বড় সবার কথা গুরুত্ব দিতে হয়
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা