পাকিস্তানি শাসন আমলে চট্টগ্রাম বেতার প্রতিষ্ঠার পর ডাক্তার কামাল এ খানের প্রযোজনায় প্রথম বেতার নাটকে তিনি ছিলেন অভিনয়ে, অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন নাট্যকার । আবার এক দশক পর স্বাধীনতার উচ্ছাসে যখন ভাসছে দেশ,সেই একাত্তর ছাড়িয়ে বাহাত্তর সালে ঢাকা বেতার নাটকে যখন প্রথমবার নবউদ্যমে, কাজী নজ্রুল ইসলামের ‘রাক্ষসী‘ নাটকের প্রচার নির্ধারিত হোল, তখনও এই জুটির দাপুটে প্রযোজনা সারাদেশে, বিশেষত পত্রপত্রিকায় তুমুল প্রশংসা পেল। হ্যাঁ, বলছি কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাক্ষসী‘ যখন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদের বেতাররূপ আর মাহবুব হাসান সাহেবের প্রযোজনায় এবং নাম্ভুমিকায় আর এক কিংবদন্তী অভিনয়শিল্পী রওশন জামিলের অভিনয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে, তখন তো তা ইতিহাস হয়ে উঠবে, সেটা নতুন কিছু নয়। সেই নাটকে প্রয়াত রাজু আহমেদ এবং বহু নামীদামী শিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন, যেটি আজও ঢাকা বেতারের জনপ্রিয়তম নাটকের তালিকায় শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, এটি আজও বিদগ্ধজনদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। এইতো সেদিনও বিশিষ্ট নাট্যজন আবুল হায়াত এক সাক্ষাতকারে বললেন, চট্টগ্রামে ওয়াজিউল্লাহ ইন্সিটিটিউট মঞ্চে মাহবুব হাসান, সাদেক আলী প্রমুখের সাবলীল অভিনয় দেখে, সেই তরুণ বয়সে তিনি এতই মুগ্ধ হন যে, অভিনয় শিল্পকেই তিনি জীবনের যাত্রাপথে আঁকড়ে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এমন একজন গুনী মানুষকে কর্মক্ষেত্রে বদলীসুত্রে খুলনা বেতারে পাওয়া যাব্তেএমন সংবাদে আমরা খুলনা বেতারে নাট্য শিল্পীরা দারুন ভাবে উদ্দীপিত হয়ে উঠি। সেটা গত শতকের আশির দশকের শুরুতে।
তো সেই সময়টায় এতো টিভি চ্যানেল,ওটিটি প্লাটফর্ম বা ইনটারনেট ছিলনা ঙ বেতার যন্ত্রই ছিল মানুষের শিক্ষা,তথ্য ও বিনোদন উপভোগের একমাত্র উপায়। আর একশো কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্র তখন সারাদেশ এবং প্রতিবেশী দেশের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা থেকে স্পষ্ট শোনা যেত। প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রোতা চিঠি লিখছেন,আর খুলনা ডাকঘর বস্তায় বস্তায় ভরে শ্রোতার চিঠি পৌঁছে দিচ্ছে নুরনগরের বেতার ভবনে।আর যেহেতু আমি তখন শ্রোতা গবেষণা ও চিঠির জবাব দানের দায়িত্বে ছিলাম, আমাদের উত্তেজনা তখন দেখে কে ! আসলে সে সময় খুলনা বেতার কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক এ টি এম মফিজুল হক ঢাকা থেকে বদলী হয়ে এসে বেতারের পুরান খোলনলচে পালটে ফেলে একে নবতর উদ্দীপনায় সাজিয়ে তুলতে প্রানান্ত পরিশ্রম করছিলেন। এমনসময় তাঁর পূর্বপরিচিত বন্ধু মাহবুব হাসানকে সহযাত্রী হিসাবে পাওয়ায় দারুন এক গতিবেগের সৃষ্টি হোল খুলনা বেতারকে ঘিরে। সবার কাছেই মাহবুব হাসান হয়ে উঠলেন ‘গুরু’। সবারই জানা ছিল তিনি শুধু চট্টগ্রাম বেতারের নয়, সাড়া দেশের বেতার জগতের এক সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তিত্ব এবং মঞ্চ নাটকের এক পুরোধা পুরুষ। তার প্রযোজনায়, অভিনয়ে সমৃদ্ধ বহু নাটক প্রচার হয়েছে বেতারে, এবং বহু নাট্যশিল্পী তৈরি হয়েছে তাঁর হাত ধরে। তিনি খুলনায় এসে প্রথম যে কাজটি করলেন, তা হোল সংস্কৃতিসমৃদ্ধ খুলনা অঞ্চলের বহু প্রবীন শিল্পীর সাথে আগ্রহ নিয়ে দেখা করলেন এবং জানতে চেষ্টা করলেন তাঁদের বেতার বিমুখতার কারণ। বেতারে পরিচালক মহোদয়ের সাথে আলোচনা করে তাঁদেরকে সসম্মানে নিজ নিজ স্থানে প্রতিস্থাপিত করলেন। নাটকের মানুষ হয়েও তিনি সঙ্গীত, কৃষি, শিক্ষার্থীদের আসরসহ প্রায় সকল অনুষ্ঠানের ফরম্যাট বদলে ফেলে আনলেন একটা নতুন সড়সবহঃঁস। বেতার তাঁর সনাতনী স্থবিরতা থেকে মুক্ত হয়ে যেন মুক্ত পাখীর মতো ডানা মেলে দিল আকাশে। শ্রোতারা প্রকৃত অর্থেই হলেন যেন অংশীজন। তিনি খুলনা, সাতখীরা, বাগেরহাটসহ সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকা, বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল (তখনও বরিশালে বেতার কেন্দ্র হয়নি) –এসব এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্পীদের গান, নাটক, জারীসারী, ভক্তিগান, ভাবগান, যাত্রাপালা –এসব বহিরাঙ্গন থেকে রেকর্ড করে এনে বারবার বেতারে অগ্রিম ঘোষণা প্রচার করে বিপুল আড়ম্বরে তা প্রচার করা হতো। বলাবাহুল্য এসব ব্যতিক্রমী উদ্যোগের নেপথ্য কারিগর ছিলেন তদানীন্তন খুলনা বেতার পরিচালক জনাব এ টি এম মফিজুল হক ও তাঁর চৌকশ একদল কর্মকর্তা। দিনরাত এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন মাহবুব হাসান। এরই ফাঁকে নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে চলেছেন। সত্যি বলতে কি এমন নিবেদিতপ্রান কঠোর পরিশ্রমী বেতারকর্মী এর আগে আমাদের চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। সেদিন বুঝেছিলাম কবি জীবনানন্দের অমর পংক্তি “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। বেতারব্যক্তিত্ব আখ্যায়িত হওয়া সহজ কথা নয়। যেমন, কলকাতা বেতারের বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। জানিয়ে রাখা ভাল, খুলনা বেতারের জনপ্রিয় রম্যনাটিকা “আয়না‘ তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসুত।
মাহবুব ভাই সংস্কৃতিসেবী ছিলেন বলেই যে সংগঠনই তাকে ডাকতো, তিনি তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হয়ে যেতেন। শিশুদের শোনাতেন মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী, উদিচী, শিশু একাডেমী– যখনই কেউ ডেকেছে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে, তিনি সেখানে হাজির। আর তাঁর সময় রক্ষা নিয়ে কত যে কাহিনী আছে ছড়ানো ! কোন কিছুর বিনিময়ে সময়খেলাপকারীর সাথে কোন আপোষ করতেন না।
যশোরের সঙ্গে তাঁর নাড়ীর টান তিনি নতুন করে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন খুলনা বেতারে চাকরী করতে এসে। তাঁর দাদা মুনশী মেহেরুল্লার পৈত্রিক ভিটা যশোর শহরের ধারেকাছে। তিনি কোন না কোন সুযোগে ছুটে যেতেন সেখানে। খুজতেন স্মৃতি, পিতা, পিতামহের। তাঁর পিতামহের স্মৃতিকে ধারন করেই স্থানটির নাম আজও মেহেরুল্লা নগর। তাঁর পিতা সে আমলে ছিলেন প্রথম শ্রেনির সরকারী কর্মকর্তা। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরন করে তিনিও অনেক বড় কিছু হতে পারতেন, পেতেও পারতেন। কিন্তু তিনি সেসব হতে চান নি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমল কান্তি‘ কবিতার ভাষায় তিনি শুধু ‘রোদ্দুর হতে‘ চেয়েছিলেন। আমাদের দেখা এই ‘অমলকান্তি‘ শিল্পীজীবনের দারিদ্র্যকে জেনে শুনে ‘কণ্টক মুকুট‘ শোভা হিসেবে বরন করে নিয়েছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও চট্টগ্রামের তরুন নাট্যসেবীদের মাঝে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। থাকতে চেষ্টা করেছেন শিল্পকলার বিভিন্ন মঞ্চে। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের আদি সংগঠকদের একজন হয়েও তিনি যেতে পারেন নি মুক্তিযুদ্ধে, এ আফসোস তাঁর ছিল ২০১১ সালের এই ১৮ই অক্টোবর তিনি আমাদের মধ্যে থেকে চির বিদায় নেন।
আজ তাঁর তের‘তম প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁর আত্মপ্রচারবিমুখ কর্মমুখর সৃজনশীল অবদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বর্তমান সদাশয় সরকারের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি এমন নির্মোহ নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতিকর্মীকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক‘ প্রদান করে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক। এর ফলে দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সংস্কৃতি কর্মীরা যথাযথ অনুপ্রাণিত হবেন এবং আত্মপ্রচার বিমুখ একজন সৎ, নির্লোভী সংস্কৃতিবান মানুষের অবদানকে জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানোর এ এক মহাসুযোগও বটে।
লেখক: বেতারব্যক্তিত্ব ও সাংস্কৃতিক কর্মী।