আওয়ামী লীগ ও যুবলীগকেও নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। এসময় তিনি সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে বলেন, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগও মানুষের ওপর নির্যাতন–জুলুম–অত্যাচার চালিয়েছে। এ দুটি সংগঠনও অনেক বেশি সন্ত্রাসী করেছে। তাই তাদেরও নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় ২০২৪ সালের বিপ্লব–আন্দোলনের সুফল মিলবে না। এই বাংলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি স্পষ্ট, আমরা চাই সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার। আওয়ামী লীগ যেন আর রাজনীতিতে ফিরতে না পারে। একই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। যদি প্রয়োজন হয়, ইসলামিক দলগুলোসহ সকল দল সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে সরকারকে। সেজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক বিভাজনের পথ থেকে সরে আসতে হবে। তিনি গতকাল শনিবার বিকেলে লালদীঘি ময়দানে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস আয়োজিত এক গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গণহত্যার বিচারের দাবি ও পার্বত্য অঞ্চলে নৈরাজ্যবাদ প্রতিরোধ, শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচারের দাবিতে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা শাখা এই গণসমাবেশ আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সাবেক এমপি শায়খুল হাদিস আল্লামা আলী উসমান। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রিদওয়ানুল ওয়াহেদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আল মাদানীর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন, মাওলানা জালাল উদ্দীন, মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন মিয়াজী, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুর রহমান হেলাল, মাওলানা আবুল হাসনাত জালালী ও আবু সাঈদ নোমান।
মামুনুল হক বলেন, শেখ হাসিনা প্রতিশোধের রাজনীতি করেছিলেন। তিনি দেশ ও মানুষের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি তার নিজের দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকেও প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল ১৯৭৫ সালে তার বাবাকে হত্যা করেছিল এ দেশের মানুষ ও আওয়ামী লীগ। এ জন্য গত ৫০ বছর ধরে শেখ হাসিনা প্রতিশোধের রাজনীতিই করেছেন। তার রাজনীতির মূলনীতি ছিল দুটি, একটি হল প্রতিশোধের ও অন্যটি বিভাজনের। অর্থ পাচার করে শেখ হাসিনা দেশকে একটি তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছেন। তারপর দেশ, জনগণ, নেতাকর্মী সবাইকে ছেড়ে পালিয়েছেন। তিনি অন্তঃসারশূন্য করে বাংলাদেশকে একটি পরনির্ভরশীল দেশ ও জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আগস্ট বিপ্লবে শেখ হাসিনার সেই প্রতিশোধ ও বিভাজনের রাজনীতির পতন হয়েছে। দেশে অনেক স্বৈরাচার ও সরকার প্রধানকে বিদায় নিতে হয়েছে কিন্তু কেউ নেতাকর্মীদের ফেলে রেখে পালিয়ে যাননি। শেখ হাসিনা বলেছেন তিনি পালান না, অথচ তাকে পালাতে হয়েছে।
মামুনুল হক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাই– ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ১৫ বছরের সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। এটাই বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের স্পষ্ট বার্তা। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে। আমরা মনে করি, এসব মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়। অন্যথায় বৈষম্যবিরোধী যে আন্দোলন–বিপ্লব, তার সুফল মিলবে না। এ ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। এই দেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি আর চলবে না। বাংলার মাটিতে তাদের আর রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। শেখ হাসিনার প্রতিটি গণহত্যার বিচার করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি গণহত্যার সহযোগিদেরও বিচার করতে হবে। এই দেশে অনেক রক্ত ঝরেছে, আর কোনো রক্ত ঝরতে দেব না।
এ শায়খুল হাদীস বলেন, কেবল জুলাই–আগস্টে দেড় হাজারের অধিক মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। আরও অসংখ্য মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের পরিবার–পরিজনদের কাছে মরদেহ পর্যন্ত পৌঁছেনি। এভাবে এই নিষ্ঠুর উপায়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমরা শুধু আগস্ট বিপ্লবের ফ্যাসিবাদকে বিদায় করেই আমাদের যাত্রা ক্ষান্ত করতে চাই না। আমরা চূড়ান্ত ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্যে মনজিল পর্যন্ত পৌঁছতে চাই। প্রয়োজনে ঘাম ঝরাতে হবে, প্রয়োজনে অশ্রু দিতে হবে, প্রয়োজনে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার মাটিতে ইসলামী বিপ্লব করতে হবে। এসময় তিনি ‘জাতি ধর্ম ভিন্ন মত– সবার জন্য খেলাফত’ স্লোগান দেন।
তিনি বলেন, আমরা বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, ইনসাফপূর্ণ বাংলাদেশ চাই। বৈষম্যহীন ও ইনসাফপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে হলে মানবরচিত তন্ত্র–মন্ত্র দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইনসাফ সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন আল্লাহ প্রদত্ত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। সে বন্দোবস্ত হলো খেলাফত ব্যবস্থা। আমরা ফ্যাসিবাদ উৎখাত করে আমাদের যাত্রা থামিয়ে দিতে চাই না। আমরা চাই পূর্ণাঙ্গ খেলাফত কায়েমের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ইনসাফপূর্ণ সমাজ গড়তে।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের নবীপ্রেমী তৌহিদী জনতার ওপর পরিচালিত গণহত্যায় এখন পর্যন্ত মামলা দায়ের হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই গণহত্যার জন্য ২০২১ সালের মোদীবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনা এবং খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হতে হবে। সে মামলায় বিচার করতে হবে। বাংলার মানুষ ইতিহাসের জঘন্যতম খুনির বিচার দেখতে চায়।
এসময় সবাইকে সজাগ এবং সচেতন থাকতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। গত ১৫ বছর ধরে যারা স্বৈরাচার দ্বারা নিপীড়িত, নিষ্পেষিত হয়েছে, যাদের দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী গুম–খুনের শিকার হয়েছে, তাদের সবাইকে ইস্পাত কঠিন ঐক্য ধরে রাখতে হবে। এখনই পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে সেই ফ্যাসিবাদকে আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যাবে না।
মামুনুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর শায়খুল হাদীস আলী উসমান বলেন, ইনসাফ ও ন্যায় ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে দেশে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বাংলাদেশের আপামর ছাত্র জনতার বৈষম্য বিরোধী যে ঐতিহাসিক এক গণঅভ্যুত্থান হয়েছে তাতে ইসনাফ প্রতিষ্ঠার এক অনন্য নজির স্থাপন হল।
তিন অধিবেশনে বক্তারা দেশের জাতীয় সংকট ও আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাদের দাবি তুলে ধরেন। একই সাথে শেখ হাসিনাসহ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গণহত্যা ও দেশের দুর্নীতি অনিয়ম অবিচারের সাথে আওয়ামী সরকারে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি মাওলানা এমদাদুল্লাহ সোহাইল বলেন, আমরা আজ এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছি যখন সারাবিশ্ব এক নতুন বাংলাদেশকে দেখছে। এই বাংলাদেশ ইতিহাসের নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে।