চট্টগ্রামের জনবহুল পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে গত ২৯ নভেম্বর ২২ তারিখে প্রকাশিত সফিক চৌধুরী সাহেবের একটি লেখা ‘সমাজে ছোট নরম হাতখানার জন্য বিশ্বস্ত হাত কই’ প্রবন্ধটি পড়ে কিছু মতামত ব্যক্ত করার ইচ্ছে জাগে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলি: জ্বী, বিশ্বস্ত হাত পিতা–মাতা, দাদা, দাদী এবং ফুফুদের হাত। আপনার লেখায় সত্য বাক্য উঠে এসেছে। যেমন সহনশীল শিক্ষা অর্থাৎ মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা আমরা নাগরিকদের মাঝে ছড়াতে পারি নি। আপনি ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, যে কোনও নাগরিক সমাজের এগিয়ে যাওয়ার পিছনে তিনটি অন্তর্নিহিত শক্তির ভূমিকা মুখ্য আর সেগুলি হচ্ছে– নাগরিকের কল্পনা শক্তি, চিন্তা শক্তি ও নাগরিকের সৃজনশীলতা এবং এগুলোর সাথে থাকতে হবে অনুশীলন। অনুশীলনের ফলে আসে দক্ষতা ও উন্নয়ন। সমাজে নাগরিকদের মাঝে লেখাপড়া বা কর্মক্ষেত্রে কর্মের মাঝে বা শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে দক্ষতার উত্তরণ ও উন্নয়নের বিকাশ ঘটিয়ে সমাজের নাগরিক পায় মননশীলতা বা মনুষ্যত্বজ্ঞান।
সফিক চৌধুরী সাহেব আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, সমাজ ও সমাজের নাগরিকগণের কি বর্তমানে তত্ত্ববাক্য শোনার বা জানার বা উপলব্ধি করার অবকাশ আছে? নেই। সবাই ছুটছে কেবল ছুটছে। আমরা সমাজের নাগরিকগণ ছুটছি, আর ছুটছি পরিনামে আমাদের কোমলমতি শিশুদের অর্থাৎ বাচ্চাদের হারাচ্ছি। আমরা মূল্যবান তত্ত্ব কথা শোনার বা বোঝার সময় পাচ্ছি না, পেলেও তত্ত্বকথার মূল্য অনুধাবন করার শিক্ষা আমাদের নেই। কারণ আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীম উদদীন, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রের মত কবি/সাহিত্যিকদের লেখা পড়ি না, কবিতা পড়ি না, কবিতা লেখি না, কবিতা শ্রবণ করি না অর্থাৎ সাহিত্যচর্চা করি না। কাজেই আমরা নীতিবান, উদার ও মহৎ ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হব কীভাবে? যার ফলে আমাদের মাঝে আসছে না মানবিকতা ও মহানুভবতা।
উপরন্তু আমাদের সমাজে এসেছে একদিকে প্রযুক্তির অপব্যবহার, অপর দিকে কিশোর গ্যাং। ফলে দেখা যাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র। কেন এই নির্মমতা? কেন এই পাশবিকতা? নগরীর জামালখানের নালা থেকে ৭ বৎসর বয়সী এক শিশুর লাশ নিখোঁজের তিন দিন পর উদ্ধার হয়। বস্তাবন্দি ছোট্ট শিশুর গলিত লাশ নাম ‘মারজানা হক বর্ষা’ উদ্ধার হওয়া অবুঝ শিশু কারো ক্ষতি করেনি। একইভাবে ই.পি.জেড থানাধীন বন্দর টিলা এলাকায় পাঁচ বৎসর শিশু আয়াতের ৬ টুকরা লাশের তিন টুকরা এ পর্যন্ত পাওয়া যায়। ময়না তদন্ত, ডি.এন.এ. টেস্ট সহ জানাজার নামাজ সমাপ্ত হয়।
কিন্তু ৫ বৎসরের আয়াত এবং ৭ বৎসরের মারজান প্রকাশ বর্ষা যদি তাদের মা–বোনের সার্বক্ষণিক নজরদারীতে থাকত সেক্ষেত্রে মার্জান দোকানে একা যেতো না এবং আয়াতকে তাঁর বাবার ভাড়াটিয়ার পুত্র চাচুর সাথে কথা বলা বা তাদের ঘরে আসা–যাওয়ার উপর কঠোর নজরদারী থাকতো, তাহলে জামালখানের মার্জান প্রকাশ বর্ষা এবং ই.পি.জেড. থানাধীন বন্দরটিলা এলাকার আয়াতকে আমরা হারাতাম না।
কেবল কোমলমতি শিশু নয়। নারীগণ বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে। খুন হচ্ছে। এসব খুনের পিছনে রয়েছে পারিবারিক কলহ। অর্থ, লেনদেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং এলাকার আধিপত্য বিস্তার।
কিন্তু কোমলমতি শিশুদের ক্ষেত্রে নির্যাতন, ধর্ষণ এবং খুনের পিছনে যে মোটিভই থাকুক না কেন উল্লেখিত উভয় খুনের বিচারকার্য দ্রুত সুসম্পন্ন করা বাঞ্ছনীয়। জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড। উপরে উল্লেখিত উভয় খুনই পরিকল্পিত এবং ধৃত আসামিদের সাথে সহযোগী আসামিও বর্তমান থাকা বিচিত্র কিছু নয়। উভয় খুনে লাশ গোপন করার প্রবণতা একক খুনির দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয়। কোমলমতি শিশুরা এখনও নিজেদের রক্ষা করার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়নি। বিশেষভাবে তারা একদিকে অবুঝ অপর দিকে আপন পর ভেদাভেদ বোঝে না যে ডাকে তার কাছেই যায়। এইক্ষেত্রে রক্তের সম্পর্কীয় অভিভাবকবৃন্দকে বিশেষ করে মা–বাবা, ভাই–বোন, দাদা–দাদি ও ফুফু, খালা সবাইকে সচেতন থাকতে হবে যাতে করে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের, ছোটমনিদের এবং বাচ্চাদের প্রতি প্রতিটি মুহূর্তে নজরদারী থাকে। সমাজ বিজ্ঞানী, অপরাধ বিজ্ঞানী এবং সুশীল সমাজ চাইবে অপরাধীর বা খুনির দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। সমাজ ও মহিলা বিষয়ক দপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং আইন মন্ত্রণালয়ের নিকট আবেদন ও অনুরোধ–উল্লেখিত দুই শিশুর হত্যাকারী খুনিদের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দণ্ড দানে সহায়তা করতে এগিয়ে আসা হোক।
লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।