৫০ কেজির হিসেবে ৩০০ বস্তায় ১৫ টন হওয়ার কথা থাকলেও ২৯৯ বস্তা দিয়ে ১৫ টন হিসেবে চাল সরবরাহ দেওয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। ২৫ এপ্রিল সকালে ১৫ টনের চালানটি গ্রহণ করে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার স্থানীয় খাদ্য গুদাম (এলএসডি)। সাথে দেওয়া হয় একটি খালি বস্তা। গতকাল রোববার বিকেলে বাঘাইছড়ি এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মংহ্লাপ্রু মারমা বলেন, ‘শনিবার সকালে একটি ট্রাকে ১৫টন চালের চালানটি গ্রহণ করেছি। চালানে ৩০০ বস্তা চাল লেখা থাকলেও ওই ট্রাকে ২৯৯ বস্তা চাল দেওয়া হয়। সাথে একটি খালি বস্তা দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বন্দরের ৪নং বার্থ থেকে এই চাল সরবরাহ দেওয়া হয়। পরে জেটিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছেন বস্তায় চাল বেশি আছে।’ গত কয়েকদিনে শুধু বাঘাইছড়ি নয়, পার্বত্যজেলা খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা খাদ্যগুদামে সরবরাহকৃত চালানেও চাল কম সরবরাহ দেওয়া হয় বন্দর থেকে।
এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা কাপ্তাইয়ের বড়ইছড়ি স্থানীয় খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) সিরাজুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ডিজিটাল স্কেলে কোথাও সঠিক ওজন পাওয়া যায় না। উমাচরণ কর্মকারের কাঁঠার নিক্তি দিয়েই সঠিক ওজন পাওয়া যায়।’ তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে ভাসমান জাহাজে কয়েকদিন চাল থাকলে আদ্রতা বেড়ে যায়। এতে চালের ওজন বেড়ে যেতে পারে। এরপর ট্রাকে পরিবহন করলে কিংবা গুদামে গেলে আর্দ্রতা কমে যাবে। পাশাপাশি ওজনও কমে যাওয়ার কথা।’
এদিকে গত ২৩ ও ২৪ ফ্রেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে ৯ হাজার ৮৩টন ৯শ কেজি চালের একটি চালান খালাস করে ‘এমভি টিভিসা’। জাহাজটি থেকে চাল খালাস তদারককারী খাদ্য পরিদর্শক কাজী ইকবাল হোসেন তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে কয়েকটি ছবিসহ স্ট্যাটাস দেন ‘ভারত থেকে আমদানিকৃত চাল এমভি টিভিসা জাহাজে উঠে কার্যক্রম তদারকিতে নিয়োজিত আমরা দুজন’। তার পোস্ট দেওয়া ছবিতে দেখা যায়, জাহাজটির হেজে বস্তার বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চাল। কাজী ইকবাল হোসেনের স্ট্যাটাসে অনেকে কমেন্ট করেন। তন্মধ্যে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা কাপ্তাইয়ের বড়ইছড়ি স্থানীয় খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল আলম কমেন্টে লেখেন, “ঝরা চালগুলো গাড়িতে উঠে?”। তখন কাজী ইকবাল হোসেন রিফ্লাই করেন, “ঝরাগুলোও সরকারের কিনা (ক্রয়কৃত) তো”। তখন সিরাজুল আলম পরবর্তী রিফ্লাইতে লেখেন, “তা ঠিক। তবে চালসহ বস্তার ওজন ৪৯.৮০০ কেজির বেশি হয় না।” এতে কাজী ইকবাল হোসেন রিফ্লাই করে লেখেন, “ঐ যে একটু পড়ে যায়, কি করব ম্যানেজ করতে হবে গো ভাই”।
ফেসবুকে এই লেখার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে ভারত থেকে আমদানিকৃত কয়েক লক্ষ টন চাল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হচ্ছে। এসব যতটন হিসেবে এলসি হয়েছে, তাতে বস্তায় ৫০ কেজি হিসেবে বস্তার সংখ্যাও এন্ট্রি থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমদানিকৃত চালে প্রত্যেক বস্তায় ৫০ কেজি হিসেবে এলসি হয়। বস্তায় আনুপাতিকহারে চালের পরিমাণ হিসেবে এলসি করা হয়। খালাসের সময় বস্তায় হুকিং করার কারণে জাহাজের হেজে অনেক চাল পড়ে যায়। ঝরে পড়া চালগুলো জাহাজে রয়ে গেলেও বস্তা হিসেবে ইনভয়েস তৈরি করে দেশের বিভিন্ন খাদ্যগুদামে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশের স্থানীয় খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদামের ম্যানেজারদের সাথে সমন্বয় করা হয়। ইনভয়েস অনুসারে জাহাজের চাল খালাস দেওয়ার পর হেজে পড়ে থাকা চালগুলো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খোলা বাজারে পাচার করে দেওয়া হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের এক উপজেলা খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) বলেন, ‘৫০ কেজির প্রতি বস্তায় গড়ে ২০০ গ্রাম করে চাল কম থাকে। এজন্য এলএসডি কিংবা সিএসডি থেকে যাদের সরবরাহ করা হয় সেখানেও কম দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি বাহিনীর রেশনের চাল সরবরাহের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে ওজন করে চাল সরবরাহ দিতে হয়। বন্দর কিংবা সিএসডি কিংবা এলএসডিগুলোতে চাল গেলে বছরে যে পরিমাণ চাল কম হয়, তা বছর শেষে গুদামগুলোতে ‘জিও ঘাটতি’ দেখিয়ে সমন্বয় করা হয়।’
চট্টগ্রাম খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ১ মার্চ হতে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১১টি জাহাজে ১ লক্ষ ৪ হাজার ৬৬২ টন ৫৫০ কেজি চাল খালাস হয়েছে। ৫০ কেজি হিসেবে ২ লক্ষ ৯৩ হাজার ২৫১ বস্তা চাল খালাস হয়। সে হিসেবে বস্তাপ্রতি গড়ে ২০০ গ্রাম হিসেবে কম হলে এই সময়ে ৪১৮৬৫০.২০ কেজি চালের হিসেব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
এদিকে বন্দর থেকে চাল দেশের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় খাদ্যগুদামগুলোতে যায়। তন্মধ্যে রাজধানী ঢাকার তেজগাও সিএসডির ব্যবস্থাপক চন্দ্র শেখর মল্লিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ কোন ট্রাকে চাল কম আসেনি। কোন ট্রাকে ২০ কেজি কম আসলে অন্য ট্রাকে বেশি এসেছে।’ একই বক্তব্য পাওয়া যায় চট্টগ্রাম দেওয়ান হাট সিএসডির ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলমের কাছ থেকেও। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক বন্দর থেকে যে চাল পাওয়া গেছে, তাতে কখনো কম পাওয়া যায়নি।’ অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানিকৃত চাল খালাসে নিয়োজিত সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক (জেটি) ফরিদুল আলম বলেন, ‘বন্দরের জাহাজ থেকে সিএসডি কিংবা এলএসডিকে সরবরাহ দেওয়া কোন ট্রাকে ভাংতি কোন চাল যায়নি। প্রত্যেক ট্রাকে ১০টন, ১৫টন, ২০টন হিসেবে ইনভয়েস হয়েছে, কমবেশি হয়নি। বন্দরের স্কেলগুলো আন্তর্জাতিক মানের। স্কেলদিয়ে মাপের প্রিন্টকপিও সংরক্ষণ করা হয়।’ তবে ট্রাকে খালি বস্তা ও চাল কম দেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা ট্রাকে বুঝিয়ে দেই। পথিমধ্যে কিছু হলে সেটির জন্য আমরা দায়ী নই। পরিবহন ঠিকাদারই দায়ী।’
এ তিন কর্মকর্তার বক্তব্যের সাথে অমিল পাওয়া যায়, জাহাজে আমদানিকৃত চালের তদারককারী কর্মকর্তা চট্টগ্রাম খাদ্য চলাচল ও সংরক্ষণ কার্যালয়ের সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সুনীল দত্তের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘জাহাজ থেকে চাল সরবরাহ দেওয়ার দায়িত্ব সরবরাহকারীর (আমদানিকারক)। জাহাজ থেকে চাল খালাস নেওয়ার সময় হুকিংয়ের কারণে বস্তা থেকে কিছু চাল জাহাজের হেজে পড়ে যায়। আবার অনেক সময় বস্তা ফেটে গিয়েও হেজে চাল পড়ে। জাহাজ থেকে যত পরিমাণ চাল সরবরাহ দেওয়া হয় ইনভয়েস অনুসারে সরবরাহকারীকে সেই পরিমাণ চালের বিল পরিশোধ করা হয়।’ বাঘাইছড়িতে খালি বস্তা সরবরাহ দেওয়ার বিষয়টি তিনি জ্ঞাত নন বলেও জানান। সুনীল দত্তকে পাহাড়তলীতে আটক চালের বিষয়ে তদন্ত কমিটিতেও রাখা হয়।
খাদ্য সরবরাহে নিয়োজিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণ হুকিং হলে বস্তা থেকে চাল বেরিয়ে যায়। ট্রাকে বস্তা লোড দেওয়ার সময় প্রত্যেক বস্তাতেই হুকিং করতে হয়। কিন্তু স্কেলে কিংবা ইনভয়েসে রহস্যজনকভাবে ওজন কম হয় না। হুকিংয়ের চালগুলোই পরে পাচার করা হয়।’
এদিকে গত ২১ এপ্রিল বুধবার পাহাড়তলী চাল বাজারে অভিযান চালিয়ে ৭০ হাজার কেজি চাল আটক করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। চাল পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্য চাল ব্যবসায়ী বাহার মিয়াকে (৪৪) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভারত সরকারিভাবে আমদানিকৃত এসব চাল বন্দর জেটি থেকে খালাস হয়ে নোয়াখালীর চরভাটা এলএসডি গোডাউনে যাওয়ার কথা ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য বিভাগের কয়েক কর্মকর্তা বলেন, ‘বন্দর থেকে বিনা ডকুমেন্টে ঝরা কিংবা সুইপিং চালগুলো পাচার করে দেওয়া হয়। খাদ্য বিভাগের অনেক কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেট জড়িত।’
রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে চলতি সপ্তাহে সরবরাহকৃত চালানে চাল কম দেওয়া ও খালি বস্তা দেওয়ার বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নাঈম মো. শফিউল আলম গতকাল রোববার রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘এটি মোটেও সম্ভব নয়। খালি বস্তা দেওয়ার সুযোগ নেই। বন্দর থেকে লোডকৃত ট্রাকে সিল করে দেওয়ার কথা। তবে বন্দর থেকে লোড হওয়ার পর এসবের দায়িত্ব পরিবহন ঠিকাদারের। গন্তব্যে গেলে পরিবহন ঠিকাদারকেই চাল বুঝিয়ে দিতে হবে।’
চলতি সপ্তাহে বন্দর থেকে সরবরাহকৃত চালের ট্রাকগুলো নির্ধারিত গন্তব্যে গিয়েছেন কী না এবং কোন গুদাম থেকে অভিযোগ পেয়েছেন কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরণের কোন অভিযোগ পাইনি। তবে পাহাড়তলীতে আটক হওয়া চালের বিষয়টি আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। পত্রিকার মাধ্যমে ওখানে ৫ ট্রাক চাল থাকার কথা জেনেছি। এখন চালগুলো কোথা থেকে এসেছে, তা চিহ্নিত করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলেই বিষয়টি জানা যাবে।’ তবে তিনি চাল পাচারে খাদ্য বিভাগের লোকজন জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘বন্দর থেকে চাল পাচারের সুযোগ নেই। ওখানে বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষী থেকে শুরু করে শিপিং এজেন্সি, সিএন্ডএফ, সরবরাহকারীর প্রতিনিধিসহ সব এজেন্সির লোকজন থাকেন।’
এদিকে জাহাজের হেজে সুইপিং, হুকিং হিসেবে ঝরা চালের বিষয়ে চট্টগ্রাম খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জাহাজ থেকে ভালো বস্তাগুলো খালাসের পর হেজে ঝরা যে চাল থাকে, সেগুলো আমরা হালিশহর সিএসডিতে নিয়ে যাই। এগুলো কোন ইনভয়েস হয় না। ওখানে বাছাই করে গুণগতমান সঠিক থাকা চালগুলো পুনরায় বস্তায় ভরে বুঝে নেওয়া হয়। যেগুলো বুঝে নেওয়া হয় সেগুলোর বিল সরবরাহকারীকে পরিশোধ করা হয়।’ ইনভয়েসবিহীন চাল বন্দর থেকে বের করার বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নাঈম মো. শফিউল আলম বলেন, ‘ইনভয়েস না হলেও রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি করে সুইপিংয়ের চালগুলো বন্দর থেকে বের করে সিএসডিতে নেওয়া হয়।’