সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, দেওয়া যাবে সর্বোচ্চ যাত্রী সেবা। নিশ্চিন্ত ও আরামদায়ক ভ্রমণের অঙ্গিকার নিয়ে মেট্রোরেল নামক যে উড়াল পথ ঢাকার আকাশে দৃশ্যমান হয়েছে, সেই পথই আজ সাধারণ পথচারির জীবন কেড়ে নেওয়ার নির্মম মঞ্চ হয়ে দাঁড়াল।
সম্প্রতি মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড মাথায় পড়ে আবুল কালাম আজাদ নামের এক পথচারীর মৃত্যুর ঘটনাটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়; এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় অবহেলা, জবাবদিহিতার অভাব এবং নাগরিক জীবনের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির এক করুণ প্রতিচ্ছবি। এই দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ যে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করেছে, তা কি নিহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা, নাকি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এক নির্মম তামাশা? এই অর্থ কি পারে একটি শিশুর ভবিষ্যৎ, একজন স্ত্রীর অবলম্বন বা একটি পরিবারের স্বপ্ন পূরণের গ্যারান্টি দিতে?
মেট্রোরেলের মতো একটি মেগা প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্ব। যখন একটি ভারী বিয়ারিং প্যাড পড়ে একজন সাধারণ পথচারীকে জীবন দিতে হয়, তখন তা চরম গাফিলতি এবং নিরাপত্তা প্রোটোকলের ব্যর্থতা নির্দেশ করে।
আর এই মৃত্যুর বিনিময়ে মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা একটি জীবনের, একটি পরিবারের ভবিষ্যতের মূল্য হিসেবে হাস্যকর। এই টাকা হয়তো পরিবারটির কিছু দিনের ভরণপোষণ যোগাবে, কিন্তু নিহত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী–সন্তানদের জীবন চলার পথ, সন্তানদের শিক্ষা ও সুচিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো কীভাবে পূরণ হবে?
আমরা যদি রাষ্ট্রের বিলাসী ব্যয় বা অপচয়ের সঙ্গে এই পাঁচ লাখ টাকাকে তুলনা করি, তবে বৈষম্যের মাত্রাটি আরও স্পষ্ট হবে। একটি ভিভিআইপি গাড়ি কেনার বাজেট, একটি অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর, অথবা দুর্নীতিতে পাচার হওয়া অর্থের ক্ষুদ্রতম অংশও এই পাঁচ লাখ টাকার চেয়ে অনেক বেশি। যখন রাষ্ট্রের অর্থ বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় খাতে গ্রোতের মতো প্রবাহিত হয়, অথচ একটি জীবনহানির পর ক্ষতিপূরণ হিসেবে এমন নামমাত্র অঙ্ক ঘোষণা করা হয়, তখন তা দেশের সাধারণ নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের চরম উদাসীনতাকেই ফুটিয়ে তোলে। এই ক্ষতিপূরণ তাই রাষ্ট্রের দায়মুক্তি অর্জনের একটি সস্তা চেষ্টা মাত্র, যা কোনোভাবেই ‘ন্যায়’ বা ‘ক্ষতিপূরণ’ শব্দটির প্রতি সুবিচার করে না।
আবুল কালামের অকালমৃত্যুর সবচেয়ে বড় শিকার তাঁর দুই শিশু। এই শিশুদের সবকিছুই এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে সঁপে দেওয়া হলো। ক্ষতিপূরণ কেবল একটি এককালীন চেক বা অনুদান হতে পারে না; এটি হওয়া উচিত দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও নির্ভরতার প্রতীক। যেমন: নিহতের বয়স ও গড় আয়ু বিবেচনা করে তাঁর সম্ভাব্য কর্মজীবনের (ধরা যাক, আগামী ৩০ বছর) গড় আয় হিসাব করে সেই পরিমাণ অর্থ একক বা মাসিক কিস্তিতে প্রদান করা। পাশাপাশি তার সন্তানদের শিক্ষা ও ভরণপোষণ নিশ্চিত করা। নিহত ব্যক্তির সন্তানের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বা উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মাসিক ভরণপোষণ এবং শিক্ষার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। এছাড়া তাঁর স্ত্রী বা পরিবারের যোগ্য কোন সদস্য থাকলে তাকে চাকরিও দেওয়া যেতে পারে।
উপরোক্ত অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের বাইরেও পরিবারটিকে মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক ক্ষতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত, যা পরিবারের মানসিক অবলম্বন হিসেবে কাজ করবে। কেবল তখনই বলা যাবে যে রাষ্ট্র তার নাগরিকের জীবনের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়েছে।
তবে দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষতিপূরণ কোন সমাধান নয়, কেননা টাকা দিয়ে জীবন কেনা যায় না। মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে কালামের মৃত্যুই প্রথম ঘটনা নয়। গতবছরও এ প্রকল্পে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলো মেট্রোরেলের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং তদারকির অভাবকে নির্দেশ করে।
বিয়ারিং প্যাডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশ পড়ে যাওয়া সরাসরি নির্মাণ সামগ্রী বা সংযোজনের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা প্রমাণ করে। অর্থাৎ, প্রকল্পের তদারকি ও গুণগত মান নিশ্চিতকরণে বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদে নিরাপত্তা মানদণ্ড উপেক্ষা করেছে কিনা কিংবা নকশা, উপাদান নির্বাচন এবং স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক ত্রুটি ছিল কিনা, তা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা জরুরি। অনেক সময় দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা হয় না।
ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, কঠোর জবাবদিহিতা এবং নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখা। তবে কালামের মৃত্যুর বিষয়টি তদন্তে শুধু নামমাত্র কমিটি নয়, অবিলম্বে স্বাধীন প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। যারা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দুর্ঘটনার মূল কারণ, নির্মাণ ত্রুটি এবং গাফিলতির জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করবে। যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা যে কর্মকর্তা নিরাপত্তা প্রোটোকল লঙ্ঘনের জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া সরকারের উচিত অবিলম্বে সড়ক দুর্ঘটনা বা নির্মাণজনিত দুর্ঘটনায় জীবনহানির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের একটি যৌক্তিক ও বাধ্যতামূলক কাঠামো তৈরি করা, যা নিহতের সম্ভাব্য আয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হবে।
আবুল কালামের অকাল মৃত্যু আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিবিম্ব। এই মৃত্যু যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অপচয় কোটি কোটি টাকা, সেখানে একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনের মূল্য মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা।
আশা করব, এই ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র তার ভুল স্বীকার করবে, আবুল কালামের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে প্রতিটি নাগরিকের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। তা না হলে, এই মেট্রোরেল উন্নয়নের মিথ্যা আখ্যান হয়ে থাকবে, যার নিচে চাপা পড়ে আছে অসংখ্য আবুল কালামের স্বপ্ন আর হতাশা।
লেখক: শিক্ষক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।












