আবারো সিরিয়ালে জাহাজ বরাদ্দ দেয়ার নোটিশ, উঠছে প্রশ্ন

সিরিয়াল প্রথা উঠে যাওয়ার পর ভাড়া কমেছিল জাহাজের, আমদানিকারকদের মধ্যেও ছিল স্বস্তি

হাসান আকবর | সোমবার , ২৫ মার্চ, ২০২৪ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনে সিরিয়াল প্রথা উঠে যাওয়ায় জাহাজ ভাড়ায় ধস নেমেছে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বহু কমে দেশব্যাপী পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। জাহাজ ভাড়া কমে যাওয়ায় আমদানিকারকেরা স্বস্তিতে রয়েছেন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে জাহাজ ভাড়ার ট্যারিফ নির্ধারণ করে রাখা অযৌক্তিক বলে দাবি করা হয়েছে। একাধিক আমদানিকারক বলেছেন, বাজারে শত শত জাহাজ। আমরা যেখান থেকে খুশি জাহাজ ভাড়া নিয়ে পণ্য সরবরাহ করবো। জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকের এই ব্যবস্থার মাঝে মধ্যস্বত্তভোগী যুক্ত হয়েই সংকট প্রকট করছে বলেও তারা মন্তব্য করেন। গত বেশ কিছুদিন ধরে মুক্তবাজার পরিস্থিতি বিরাজ করার পর আজ থেকে আবারো একই সিরিয়ালে জাহাজ বরাদ্দ দেয়ার নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। একই সিরিয়ালে আনার জন্য নোটিশ প্রদান করা হলেও ভাড়ার ব্যাপারে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। ডব্লিউটিসির নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বহু কমে এতোদিন লাইটারেজ জাহাজ পণ্য পরিবহন করলেও এখন আবার সেই ভাড়ায় কেন যেতে হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের নৌ বাণিজ্য দফতর, আমদানিকারক এবং জাহাজ মালিকেরা বসে ভাড়ার ব্যাপারটি সুরাহা করার পরই সিরিয়ালের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে তারা মন্তব্য করেন। তারা প্রশ্ন তোলেন, এতোদিন যদি কম ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করা যায় তাহলে এখন যাবে না কেন? একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে বছরে প্রায় দশ কোটি টন পণ্য পরিবাহিত হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহনে অন্তত ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজের চলাচল ও সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণের জন্য লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন যথা বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়েই ডব্লিউটিসি গঠন করা হয়। ডব্লিউটিসি ভাড়া নির্ধারণ করে দেশব্যাপী পণ্য পরিবহন করে আসছিল। ভাড়ার ওই হার নিয়ে আমদানিকারকদের প্রচুর ক্ষোভ থাকলেও ডব্লিউটিসির নিয়ন্ত্রণের কারণে চড়া ভাড়াতেই পণ্য পরিবহন করতে বাধ্য হয়েছেন আমদানিকারকেরা। কিন্তু নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ডব্লিউটিসি থেকে ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) বের হয়ে আলাদা সেল করে। ওই সেল থেকেও সিরিয়ালের মাধ্যমে জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়। ডব্লিউটিসির নির্ধারিত ভাড়া ঠিক রেখেই আইভোয়াক নিজেদের মতো করে সিরিয়াল দিয়ে জাহাজ পরিচালনার চেষ্টা করে। এখানেও নানা দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ উঠে। এক পর্যায়ে আইভোয়াকের কার্যক্রমও থমকে যায়। নৌ বাণিজ্য দফতরের মূখ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ডব্লিউটিসির নির্ধারিত ভাড়া ঠিক রেখেই জাহাজ পরিচালনার চেষ্টা করা হয়। সেটাও অনেকটা ভন্ডুল হয়েছে। কোনো জাহাজ মালিক সিরিয়ালে এসেছেন, কেউ আসেন নি। তবে ভাড়া রাখা হয় ডব্লিউটিসির নির্ধারিত হারেই।

ডব্লিউটিসি, আইভোয়াক কিংবা পিও এমএমডির অফিসকোনো উদ্যোগই সফল না হওয়ায় জাহাজ মালিকেরা মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারায় নিজেদের জাহাজ নিজেরাই ভাড়া দিতে শুরু করেন। আমদানিকারকেরাও নিজেদের মতো করে ট্রাক ভাড়া নেয়ার মতো করে জাহাজ ভাড়া নিতে থাকেন। এতে করে গত মাস দুয়েকে জাহাজ ভাড়া বহুলাংশে কমে গেছে। জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকের দর কষাকষির পর যে ভাড়া নির্ধারিত হয়ে পণ্য পরিবাহিত হচ্ছে সেটাই জাহাজের প্রকৃত ভাড়া বলে মন্তব্য করে আমদানিকারকেরা বলেছেন, জাহাজ মালিক লাভ করতে পারছেন বলেই তো এই ভাড়ায় জাহাজ চালাচ্ছেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ডব্লিউটিসির নির্ধারিত ভাড়া ছিল প্রতিটন ৫৭৪ টাকা। অথচ বর্তমানে ওই পণ্য ৪৪০ টাকায় ঢাকায় পৌঁছাতে পারছেন আমদানিকারকেরা। ডব্লিউটিসির নির্ধারিত লোকাল ভাড়া ছিল প্রতিটন ৩২২ টাকা, যা এখন কমে ২০০ টাকায় ঠেকেছে। যশোরের ভাড়া ছিল প্রতিটন ৯৫০ টাকা, যা এখন কমে ৮০০ টাকায় পরিবাহিত হচ্ছে। জাহাজ ভাড়া কমে যাওয়ায় আমদানিকারকেরা বেশ লাভবান হয়েছেন বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এই প্রক্রিয়ায় জাহাজ মালিকেরাও লাভবান হয়েছেন। মাসের পর মাস সিরিয়াল দিয়ে বসে না থেকে তারা নিজেরাই ভাড়া খুঁজে নিচ্ছেন। এতে করে জাহাজের ট্রিপের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। কোনো ধরনের ঝামেলা না থাকায় নিজেরা নিজেদের মতো করে ভাড়া ম্যানেজ এবং পণ্য পরিবহন করছেন। বিদ্যমান ব্যবস্থায় আমদানিকারক এবং জাহাজ মালিকদের অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

এদিকে নৌ বাণিজ্য দফতর থেকে আবারো আজ থেকে একই সিরিয়ালে জাহাজ বুকিং এবং অনুমোদন নিয়ে পরিচালনার ব্যাপারে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট জাহাজ মালিক, জাহাজ মালিকের প্রতিনিধি, আমদানিকারক এবং আমদানিকারকের প্রতিনিধিকে নোটিশ প্রদান করে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জাহাজ বুকিং নেয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তবে ওই নির্দেশনায় ভাড়ার ব্যাপারে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। আমদানিকারকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, কোন ভাড়ায় পণ্য পরিবাহিত হবে? এতদিন যেই ভাড়ায় মুক্তবাজারে পণ্য পরিবাহিত হচ্ছিল সেটা নাকি ডব্লিউটিসির নির্ধারিত আগেকার চড়া ভাড়া। বিষয়টির সুরাহা করা খুবই জরুরি বলেও তারা মন্তব্য করেন।

আমদানিকারক এস এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, জাহাজ ভাড়া কমে গেছে। এতে আমাদের লাভ হচ্ছে। যে লাভের অংশীদার দেশের সাধারণ ভোক্তারা। এটা না করে চড়া ভাড়া চালু করার জন্য যদি জাহাজের সিরিয়াল প্রথা পুনরায় আনা হয় তাহলে সেটা কোনোভাবেই কল্যাণকর হবে না। তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় ট্রেনের সঙ্গে কাঠবোঝাই ট্রলির সংঘর্ষ
পরবর্তী নিবন্ধআন্দোলনে প্রশিক্ষণরত ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা