বিশিষ্ট দানবীর, শিক্ষানুরাগী, ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মরহুম আলহাজ্ব ্লআবদুল মাবুদ সওদাগরের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০১ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম শহরের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা মৌলভী আবদু রশিদ ছিলেন এলাকায় একজন ধর্মপ্রাণ ও অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। মা আছমা খাতুন ছিলেন একজন পর্দাসীন মহীয়সী নারী। ৩ ভাই ২ বোনের মাঝে তিনি ছিলেন ৩য়। স্কুল জীবন শেষে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ব্যবসায় নামেন। একান্ত নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, অধ্যবসায় সহকারে যারা ধাপে ধাপে জীবনের উচ্চতর সোপানে আরোহন করেছেন। তন্মধ্যে মরহুম আবদুল মাবুদ সওদাগর ছিলেন অন্যতম, ব্যবসায়িক সাফল্য তাঁকে সমাজবিমুখ করেননি বরং সমাজ সেবায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। গ্রামে এবং শহরে বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। তন্মধ্যে তিনি চট্টগ্রাম শহরে বাইশ মহল্লার সর্দার কমিটির সদস্য ও মহল্লা সমিতির সহ–সভাপতি। এছাড়াও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র ঝাউতলা, জামালখান, কদম মোবারক, রহমতগঞ্জ, আন্দরকিল্লা মহল্লা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিষ্ঠা ও সততার সাথে পালন করেন। তিনি কদম মোবারক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য, চাঁদপুর, কাদেরিয়া, হোসাইনিয়া, রশিদিয়া দারুল উল্লুম ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। নাটমুড়া পুকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি সবচেয়ে বড় আর্থিক অনুদান প্রদান করেন এবং স্কুল পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য আলাউল ডিগ্রী কলেজ গভর্নিং বডির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। চাঁদপুর আছমা খাতুন জামে মসজিদ ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, খাতুনগঞ্জ আমির মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা এবং পুকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রথমে সদস্য ও পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানার সাথে তিনি দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা করেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির এতিমখানার আজীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়াও জেলা হজ্ব কমিটির সদস্য লায়ন্স ক্লাব ও রেড ক্রিসেন্টের আজীবন সদস্য ছিলেন। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম শহরে তার অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বন্ধু ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন, প্রখ্যাত রাজনীতিবীদ আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র বড় ভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরী, সে সময় বাংলাদেশে জাপানের টয়োটা গাড়ির কোম্পানীর প্রধান এজেন্ড ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে মাবুদ সওদাগর বন্ধুর কাছ থেকে একটি টয়োটা আর–টি–ফর্ট্টি ’৬৬ মডেলের একটি প্রাইভেট কার ক্রয় করেছিলেন। ঐ সময় চট্টগ্রাম শহরে হাতেগোনা কয়েকজন বাঙালি ব্যবসায়ীর কাছে প্রাইভেট কার ছিল। এছাড়া কাজির দেউড়ী এ্যাপেলো শপিং এর স্বত্বাধিকারী ও খাতুনগঞ্জের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জাকিরিয়া ব্রাদার্সের মালিক আলহাজ্ব আবুল ফয়েজ, প্রখ্যাত শিল্পপতি ইলিয়াছ ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব মোহাম্মদ হোসেন; প্রখ্যাত শিল্পপতি ছালেহ কার্পেট মিলের মালিক সাবেক সিটি মেয়র আলহজ্ব মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর শ্বশুর আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ সওদাগর, বাঁশখালীর আরেক কৃতী সন্তান চট্টগ্রামের কাপ্তাই পাওয়ার হাউজ নির্মাণের অন্যতম ঠিকাদার আলহাজ্ব হারুন রশিদ প্রকাশ (বহাদ্দারও হারুন) এছাড়াও বাঁশখালীর আরেক কৃতি সন্তান ডাঃ জমির উদ্দীন ও তার স্ত্রী ডাঃ আনজুমানারা বেগম মাবুদ সওদাগরের মোমিন রোডস্থ বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। ভাড়াটিয়া হলেও তিনি তাদেরকে পরম আত্মীয় হিসেবে জানতেন। ঘরে ভালোমন্দ কোনো রান্না হলে তাদেরকে ফেলে খেতেন না। অত্যন্ত বড় মনের মানুষ ছিলেন মরহুম আবদুল মাবুদ সওদাগর। তাঁর পুত্রগণ হচ্ছেন মরহুম শামশুল আলম, মোহাম্মদ নুরুল আলম, মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম, মোহাম্মদ খোরশেদ আলম (উপজেলা চেয়ারম্যান, বাঁশখালী), মোহাম্মদ ইলিয়াছ আলম, মোহাম্মদ ফরিদুল আলম, মোহাম্মদ রফিকুল আলম, মোহাম্মদ শফিকুল আলম, মরহুম ওয়াহিদুল আলম, কন্যা মরহুমা রওশন আরা, জাহান আরা, মরহুমা হোসনে আরা, সোনি আরা, মরহুমা শাহানারা, জুলিয়ারা, রোজিনা সুলতানা, রুবিনা সুলতানা, সাবিনা সুলতানা সন্তানগণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল ও প্রতিষ্ঠিত। মরহুম আবদুল মাবুদ সওদাগর একজন সৎ, সামাজিক, উদার, ত্যাগী, কর্মঠ, নিরলস, পরিশ্রমী, পরোপকারী, ন্যায়–নীতির অধিকারী ও আল্লাহ ভীরু পরহেজগার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাদাসিধে চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি একজন অরাজনৈতিক সমাজপতি হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত ও সম্মানের অধিকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ব্যবসায়ীক ও অন্যান্য কাজে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বার্মা, সৌদি আরব সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রথম পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। ২০১০ সালে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় অনুমোদিত সরকারি নিবন্ধনকৃত একটি সামাজিক সংগঠন কর্তৃক সমাজে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক হিসেবে স্বর্ণ পদক লাভ করেন। বর্তমানে এলাকায় তাঁর নামে ‘আবদুল মাবুদ ফাউন্ডেশন’ একটি সেবামূলক সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতিবছর ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘মাবুদ স্মৃতি বৃত্তি’ প্রদান এসএসসি ও সমমনা পরীক্ষায় জিপিএ–৫ প্রাপ্তদের সংবর্ধনা, সম্মাননা স্মারক ও আর্থিক অনুদান প্রদান, গরীব ও দুস্থদের মাঝে বস্ত্র বিতরণ, শিশুদের খৎনাসহ বহু উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যা এলাকায় ইতোমধ্যে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়াও বিগত বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনা চলাকালিন সময়ে বাঁশখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রি বিতরণসহ আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। তাঁর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি তিনি যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। আমীন।
লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক।