আফগানিস্তানি আলোকচিত্রী ফাতিমা হুসাইনি: বসন্তের চোখ

নারীর ইমেজ, ইমেজে নারী

 সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ৫ অক্টোবর, ২০২৪ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

আমাদের নিত্য যেখানে আসাযাওয়া, অল্প গুছিয়ে আপন হওয়া কিংবা বছরের অভ্যাসে পরিণত খণ্ডকে ভূমি বলে আঁকড়ে ধরি নিশ্চিত। শত কোটি আগে এ ভূমি ছিল অতি উষ্ণ, উত্তপ্ত। সময়ের সাথে সেতাপ কমে ধীরে ধীরে কঠিন রূপ নিয়েছে। আমাদের ভূত্বকের ভেতরের স্তর এখনো উষ্ণ, তরল, সঞ্চারণশীল। যেসব প্লটে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের আগেই তারা বিবর্তিত হয়েছে, সামান্যতম সেন্টিমিটারে। তবে সে বিশালতার সাপেক্ষে আমরা অতি ক্ষুদ্র আকারেই, আকাশসম মন যার তার বিশালতাকে কোনো দ্রাঘিমায় ফেলা বিরাট ভুল। তবুও তো আমরা মানুষ! আদিম থেকে সভ্য হওয়ার যাত্রায় কেবল রেখা টেনেছি নিষ্ঠার সাথে। পূর্বে হত্যাকৃত প্রাণীর হাড় দিয়ে দেওয়ালে আঁচড় দিতাম বর্তমানে ভূখন্ডে অক্ষ আর দ্রাঘিমা মেপে রেখা টানি। যেকোনো রেখাই বিপ্লব ঘটায়। শিল্পের কাজ বিপ্লব করা অথবা শিল্পীর কাজ বিপ্লবের কিনা তা অমীমাংসিত রেখে সূচনা হতে পারে।

আফগানিস্তানের প্রথম ভোরের আলোরেখা তার বাসিন্দাকে টেনে তোলে গভীর ঘুম থেকে। মিষ্টি আলোতে প্রত্যেক সন্তান তার সুন্দর দিনের জন্যে প্রস্তুত হয়, দল বেঁধে মক্তবের পথে। আলো বাড়লে পুরুষেরা কাজের উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পড়ে শহরে। বিশ্ববিদ্যালয়গামী শহুরে নারী পুরুষেরা কোনো এক ক্যাফেতে বসে বিখ্যাত সব কফি চেখে নেয়, কোনো পরিধেয় পোশাকের দোকানে বিক্রির পাশাপাশি নারীর দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সুরে মোহিত থাকে শহর। এমন সুরভিত অক্ষ কে না ভালোবাসে। তবে বারংবার নির্বাসনের কর্কশ রেখায় কেউ নিজেকে হারাতে চায় না আর। এমনই সুন্দর এক ভোরে ফাতিমা তার বন্ধুদের বলেছিল, দেখবে কেউ আমাদের কাবু করতে পারবে না। আমাদের জয় হবেই। আবারো আমরা একসাথে কফির আড্ডা দেব। দিন না গড়াতেই ফাতিমা জানতে পারে এই ভূখণ্ড তার অচেনা, শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, তালেবান ক্ষমতায় এসেছে। তীব্র অনুশোচনা আকাশসম, বিশালতা ভূমিহীন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার বন্ধুর শেষ চিঠি পড়ছে, আমাদের দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছে তারা, কোথাও কোনো শিল্পী, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী আছে কিনা। তারা খুঁজে খুঁজে বের করছে আমাদের সাথীদের।

১৯৯২ সালে ইরানে জন্ম ফাতিমা হুসাইনির। ফাতিমার পূর্বস্বরীদের সোভিয়েত আগ্রাসনের কারণে পালাতে হয় আফগানিস্তান থেকে। ফলত নিজের ঐতিহ্যের কারণে যথেষ্ট বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে ইরানে। পরবর্তীতে বিভিন্ন অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে থেকেছেন। বছরের পর বছর যাপন করেও, যাপিত জীবনে কেবল আফগানিস্তানের গল্পই শুনেছে বাবামায়ের মুখে। তাই নিজের সদ্য বসন্তে সিদ্ধান্ত নেন, এবারের যাত্রা কাবুলের পথে। ফাতিমা জানতেন, আফগানিস্তানের যেসব গল্প বা সংবাদ নিত্য হেডলাইনে ভেসে আসে তার চেয়েও অধিক কিছু রয়ে গেছে। নারীদের পর্দার আড়ালের সুর, শিল্পের যে ধ্বনি তাকে ইমেজে রূপান্তর করতেই ২০১৮ সালে আফগানিস্তানে যান ফাতিমা। মুক্ত বসন্তের চোখে, একুশ শতকের নারীদের গল্পকে বিশ্ব দরবারে পেশ করতে লেন্সে ভরসা পেয়েছিলেন।

ফাতিমার প্রথম দিকে আফগানিস্তানের পুরুষদেরকে চরমপন্থী মনে হতো কেননা তারাই সেসব নারীদের পিতা, ভাই, স্বামী, সন্তান রূপে তাকে বাধা দিয়েছে। অসংখ্যবার অপমান এবং হুমকির মুখে পড়েছেন ফাতিমা। কিন্তু পরবর্তীতে নারীদের সাথে নিবিড় সখ্যতা আফগানিস্তানের বাস্তবচিত্র বুঝতে ফাতিমাকে সাহায্য করে। ফলে প্রত্যেক ক্লিকেই সমাজের রীতিতে তীর ছুঁড়তে হয়েছে তাকে। একজন আলোকচিত্রীর জন্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জ, অবজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, দ্বিতীয়বারে সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে আফগানিস্তানে ফাতিমার জন্যে সাবজেক্টই একটা ট্যাবু ছিল। কিন্তু সময়ে আলোছায়ার পরিমিতিতে তার লেন্সে নারীদের গল্পগুলোর প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে।

আফগানিস্তানের রুক্ষ পাহাড়ের ধ্বনি এবং নারীদের বসন্তের সুরকে নিজের ভাষায়, লেন্সে ফুটিয়ে তোলার যাত্রা কঠিন ছিল। প্রথম দিকে আফগানিস্তানের শহরে, ক্যাফেতে নারীরা হিজাব ছাড়াই চলাফেরা করতেন, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। নিজেদের মত গান, অভিনয়, ছবি আঁকা এমনকি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অবাধে বিচরণে বাধা ছিল না। কিন্তু ২০২১ সালে কাবুলে তালেবানি শাসন সমস্ত কিছু বিগড়ে দেয়। নারীদের হিজাব ছাড়া বের হওয়া নিষেধ, ১২ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো মেয়ে সন্তান স্কুলে যেতে পারত না, এমনকি বিউটি পার্লার বন্ধ থেকে শুরু করে দরজায় দরজায় শিল্পী, সাংবাদিকদের খোঁজা হচ্ছিলো। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ভেতরে স্বাধীনতা এবং আশার আলো ফাতিমাকে উজ্জীবিত করে। নিজের পৈতৃক ভূমিতে মায়ের গন্ধ তাকে আরো আপন করে তোলে।

ফাতিমার বেশিরভাগ ছবিই ছিল নারীদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভূমিকা কেন্দ্রিক। আফগানিস্তানের বিচিত্র রঙিন পোশাকে আবৃত নারীরা দোকানের সামনে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন, সুরে মগ্ন সে নারীর পায়ে শক্ত চামড়ার জুতা। নারীর শক্তিশালী রূপকে আবারো প্রকাশ্যে আনতে স্টেজড ফটোগ্রাফির সাহায্য নিতে হয়েছে ফাতিমাকে। ভীড়ের মাঝে দোকানের সামনে রাখা সাইকেলের পাশে লম্বা এক চেয়ার তাতে বসেই পত্রিকা পড়ছেন এক নারী, চোখে বিশাল এক কালো চশমা। এর পাশেই রাখা আফগানিস্তানের দেশীয় নকশায় ওড়না, চাদর। ফাতিমার ছবির অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, আলো ছায়ার খেলা। বেশিরভাগ ছবিতেই ফাতিমা ভোরের রোদে আলোকরেখাকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন আশপাশের অবজেক্টকে কেন্দ্র করে। তাই রঙিন সেসব ছবির সম্পাদিত রূপ অতিশক্তিশালী এক আবহ তৈরি করে। এছাড়া অসংখ্য পোর্ট্রেট ছবিতে, আফগানিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী, সাংবাদিক, আলোকচিত্রীদের তুলে এনেছেন ভিন্নভাবে। শুধু তাই নয়, অসংখ্য সমাগমের রাস্তায় ইলেক্ট্রিক গিটার হাতে দীর্ঘ চুল খোলা নারীর ছবিটি, প্রতিবাদের অন্যতম প্রতীক ধরে নেওয়া যায়। কেননা প্রত্যেক ছবিতেই নারীদের চোখের ভাষা এর আগে কোনো লেন্সে ধরা পড়েছে কিনা জানি না, যেখানে চোখই বলছে তাদের ভেতরকার গল্প; স্পষ্ট, গাঢ় এবং ক্ষুব্ধ।

তাছাড়া ছোট শিশুদের ভোরের আলো বেরুবার আগেই সাদা পোশাকে সম্পূর্ণ আবৃত করে রাখা, মক্তবে পাঠানো যেখানে লেন্সে তাক করে আছে বিভ্রান্ত চোখ কিংবা মধ্য বয়সীর নারী হিজাববোরকা পরে সাইকেল চালানোর ইমেজ সবই শহর থেকে দূরে আফগানিস্তানের ভিন্ন আদিম গল্পও ব্যাখ্যা করে। ফাতিমা জানেন তিনি দীর্ঘ সময় ধরে কাবুলের রাস্তায় হাঁটতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন, স্টেজড ফটোগ্রাফিতে ততোধিক শ্রম এবং সময় প্রয়োজন তবুও পথের এ ছবিগুলোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তার সামনে। কেননা তার সমস্ত আশা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় যখন তালেবান ক্ষমতায় আসে। মন মেনে নিতে নারাজ, পৃথিবীর ক্ষমতাশীল চোখ ফাঁকি দিয়ে তালেবান এভাবে ক্ষমতায় আসতে পারে।

ফাতিমা বিশ্বাস করেন আফগানিস্তানের নারীদের গল্প পৃথিবীর বুকে জিইয়ে রাখার ক্ষমতা একমাত্র ইমেজেরই আছে। তার ইমেজ স্বয়ং একেকটা গল্প, এবং এই গল্পগুলোই প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে এবং নারীর স্বাধীনতা এবং ক্ষমতার জবানবন্দী দেবে।

ফাতিমা তার কাজে আদর্শ হিসেবে শিরিন নেশাতকে সম্মুখে আনেন। সাথে পূর্বসূরী ভিভিয়ান মায়ার, সোফি ক্যালি, জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরুনকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

আফগানিস্তানে ফাতিমাকে আরো উৎসাহ দেয়, তার করা প্রদর্শনী। যেখানে অসংখ্য নারী দর্শকের ভীড় তাকে পরবর্তী ‘সিল্ক রোড’ কাজের জন্যে এগিয়ে নিয়েছে। আফগানিস্তানে নারীদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অন্যতম বিষয় ছিল, তার নিজস্ব অস্তিত্ব সংকট। এক সাক্ষাৎকারে ফাতিমা বলেন, অভিবাসন, অস্তিত্ব সংকট, লিঙ্গ এ তিনটি বিষয়ই আমার কাজের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। ইরানে জন্মগ্রহণ করেও নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব ছিল না যেহেতু আমার পূর্বসূরী আফগান। এছাড়া দিনের পর দিন স্কুলকলেজে বৈষম্য আমার মনশরীরকে টুকরো করেছে। তবুও আমি ইরানিয়ান শিল্পকলার সূত্রকে ধারণ করি। আমার শিক্ষকদের প্রতি সম্মানে এখনো নত হই।

পূর্বে আফগানিস্তানে মোরাল পুলিসিং হতো না, সরকার বাধ্য করতো না হিজাব পড়তে কিন্তু তালেবানি ক্ষমতার পরে ফাতিমাকে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হিজাব পরতে হয়েছিল। অসংখ্য তরুণতরুণীরা সেই সময়কালে আফগানিস্তানে ফেরত এসেছিলো নিজেদের দেশকে সংস্কার করবে বলে। কিন্তু তালেবানের রুদ্ধশ্বাস নির্যাতনের মুখে অন্যদের মত ফাতিমারও আবার নিজের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। দুঃখের বিষয় তালেবানের সাথে আঁতাত করা আমেরিকাতেই তার ভিসা হয় এবং সেখানে ফিরতে হয় তাকে। পরবর্তীতে সে প্যারিসে চলে যায়। কিন্তু নিজেদের ভূমি হারা বেদনায় এখনো কাতর ফাতিমা। ‘আমরা কখনোই আফগানিস্তানের মানুষকে বর্জন করতে পারি না, এবং এটা করা কোনো অবস্থাতেই উচিত নয়’। এমন বলিষ্ঠ বার্তাই জাতিসংঘে দিয়েছিলেন ফাতিমা।

ভূমির স্বাধীনতা একই সাথে যেমন ধ্বংস ডেকে আনে তেমন নিজের বলে একটা বিমূর্ত শক্তিকে মনে ঠাঁই দেয়। তাই সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে আমরা প্রত্যেকে নিজস্ব একটা কামরা চাই, নিজের দেশ বলতে গর্বিত থাকি। নিজস্বতাকে ভালোবেসেও অন্যের জন্যে ভাবতে কার্পণ্য করি না, যদি বৃহত্তর সেই গোলকের কথা ভাবি, যেখানে আমরা সকলে একই ভূখন্ডের অংশ ছিলাম। অন্যের স্বাধীনতা আমাদের পরম শান্তির হয়, যদি না তা আমার স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

যেকোনো ইমেজের বা শিল্পের রেখাই আদিম থেকে অন্ত বিপ্লবের। যেমন সারাজীবন প্রেমভালোবাসার কবিতা লিখে কবি হয়ে উঠেন যুদ্ধ রোধে অন্যতম শক্তি তেমনই ইমেজও কেবল সহিংসতা, দুর্ভোগ না দেখিয়ে যেকোনো শক্তিশালী বক্তব্য পেশ করতে পারে। ইমেজ থেকে ইমেজের গল্পে, বর্তমান নয়া প্রযুক্তি মাধ্যমে ফাতিমা হুসাইনির একক বায়োগ্রাফি পাওয়া দুষ্কর ছিল। কেবল খণ্ডিত সাক্ষাৎকার বা বক্তব্যের বেশি বের করা সাধারণ পাঠকের জন্যেও কঠিন। তবে একুশ শতকের অন্যতম শক্তিশালী কণ্ঠস্বর ফাতিমা হুসাইনি স্বয়ং ইমেজের অংশ হয়ে থাকবেন পরবর্তী সময়ে একথা বলা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম
পরবর্তী নিবন্ধবিএসসির আরেকটি অয়েল ট্যাংকারে আগুন, ৩৬ ক্রু উদ্ধার