সাড়ে সাত বছর আগে রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত জঙ্গির সাজা পাল্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে হাই কোর্ট। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার এই রায় দেয়। রায়ে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়, যা অনাদায়ে তাদের আরও ৫ বছর কারাভোগ করতে হবে। এছাড়া বিচারিক আদালতের অন্যান্য ধারায় দেওয়া দণ্ডগুলো বহাল থাকবে এবং একইসঙ্গে চলবে। রায় ঘোষণার সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নির্মল কুমার দাস, সায়েদা শবনম মুশতারী, মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।
এদিকে সন্ত্রাসী এই হামলায় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আলোচিত ওই হামলার মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে সাতজনের আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশের রায়ে এমন মন্তব্য করেছেন হাই কোর্ট। রায়ে আদালত আরও বলেন, নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডটি জনসাধারণের মনে চরম আতঙ্ক সৃষ্টিসহ জননিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
দ্বৈত বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান রায় পড়ে শোনান। ডেথ রেফারেন্স রায়ে সাজা কমানোর যুক্তি দেখাতে গিয়ে বিচারক সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯–এর ৬ ধারা ব্যাখ্যা করেন। এ আইনের ৬(১)(ক)(আ) ধারায় ডেথ রেফারেন্সের রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়ে বিচারক বলেন, এ ধারার অপরাধে আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু বিদেশি নাগরিক হত্যাসহ রাষ্ট্রের দুর্নাম ঘটানোর মতো অপরাধ সংঘটন করায় তাদের আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যতদিন তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু না হবে, ততদিন তারা কারাগারে থাকবেন।
গত ১১ অক্টোবর উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রায়ের জন্য এ দিন ঠিক করেছিল আদালত। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুনানির জন্য মামলাটি কার্যতালিকায় ওঠে। এরপর ৩ মে থেকে শুনানি শুরু হয়। এর আগে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য এ বেঞ্চ ঠিক করে দেন প্রধান বিচারপতি। সেই অনুযায়ী তা কার্যতালিকায় আসে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে। পাঁচ তরুণ জঙ্গি রোজার ঈদের এক সপ্তাহ আগে পিস্তল, সাবমেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছিল সেই রেস্তোরাঁয়। তারা গলা কেটে ও গুলি চালিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে কমান্ডো অভিযানে ওই জঙ্গিদের হত্যা করা হয়।
ওই হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় রায়ে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রায়ে সাতজনকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করেছিলেন। আরও দুটি ধারায় তাদের কয়েকজনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আসামি মিজানুর রহমানকে খালাস দেওয়া হয় রায়ে।
রায় ঘোষণার পর নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলার ডেথ রেফারেন্স ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর বিচারিক আদালত থেকে হাই কোর্টে আসে। হাই কোর্টের ডেসপাস (আদান–প্রদান) শাখা সেগুলো গ্রহণ করে পাঠায় ডেথ রেফারেন্স শাখায়। পেপারবুক শাখা সেসব নথিপত্র যাচাই–বাছাই করে নথিসহ রায়ের অনুলিপি ও আনুষঙ্গিক নথিপত্র পেপারবুক তৈরির জন্য ফেব্রুয়ারিতে বিজি প্রেসে পাঠিয়ে দেয়।
পাঁচ মাসের মাথায় ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট সেই পেপারবুক বিজি প্রেস থেকে হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা পড়ে। ততদিনে দেশ করোনাভাইরাস মহামারীর কবলে পড়ে। শুনানি শুরু হতে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়।