আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও প্রাসঙ্গিক কথা

ড. আনোয়ারা আলম | মঙ্গলবার , ৭ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছরের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে নানাভাবে। পত্র পত্রিকায় লেখালেখি, মিডিয়ায় টকশোতে আলোচনা, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা কী অর্জন বা অপ্রাপ্তি। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেও নানা নেতিবাচক ভাবনা দিবস ঘিরে। বাংলাদেশের নারীরা এগিয়েছে অনেক। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে কোথায় নেই আমাদের নারীসমাজ। এমনকি কোভিড ১৯ আক্রান্ত সময়ে নারীরা যেভাবে একহাতে অর্থনৈতিক দিকটা সামাল দিয়েছে তাঁদের সৃজনশীল ক্ষমতা দিয়ে তা অবশ্যই পরম বিস্ময়ের। অনলাইন উদ্যোক্তার বিকাশে অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর চেষ্টায় প্রতিনিয়ত নারীর মেধা ও মননের ব্যবহার প্রশংসনীয়।

তবে প্রশ্নটা থেকেই যায়! নারীর পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন কি যথাযথ ভাবে হয়েছে? ঐতিহাসিক ভাবে দেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নারীরা সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু কতোটা স্বীকৃতি ইতিহাসের পাতায়। আমরা কতোজনকে পাই বা পেয়েছি! বরং তাঁদের অবদানের সামান্যই সামনে এসেছে।

এমনকি কোভিড ১৯ এ একদিকে নারীর সংগ্রাম, অন্যদিকে তাঁদের প্রতি পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে সহিংস আচরণ। পোশাক নারী কর্মীদের নিয়ে পুঁজিপতিদের নিষ্ঠুর আচরণ।

সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি জাতক স্বাধীন। এতে নারী ও পুরুষে কোনো ভিন্নতা নেই। তাহলে সংকটটা কোথায়? প্রধান সংকট হচ্ছে, আমরা নারীদের যতটা নারী ভাবি ব্যক্তি হিসেবে ভাবি না। এ কারণে নারীর সমস্যা যতোটা সময় যাচ্ছে ততোটা মেয়েলি হচ্ছে, ব্যক্তিক হচ্ছে না। পারিবারিক বা সামাজিক ভাবে নারীরা যে কোনো ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র হচ্ছে না। তার অন্যতম কারণ পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা। নির্ভরতা ও স্বাধীনতা দুটো ভিন্নার্থক, দুই সমান্তরালে অবস্থিত। তবে স্বনির্ভরতা আসতে হবে প্রধানত অর্থনৈতিক এবং একই সাথে মানসিকভাবে। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধি করেছি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েও অনেক নারী মানসিকভাবে নির্ভরশীল। তবে নারী স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতাও নয়। এটি হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও দায়িত্বশীলতা।

একই সাথে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন, বিশৃঙ্খল ও অপরাধপ্রবণ সমাজে নারীর নিরাপত্তা ভঙ্গুর ও বিপন্ন। নারী নির্যাতনধর্ষণ বা আত্মহত্যাজনিত ঘটনা বেদনাদায়ক যা প্রশ্নবিদ্ধ করছে নারীর অধিকার ও মর্যাদাকে। একজন প্যালেস্টাইনি নারীর বক্তব্যে-‘নারী হিসেবে আমার কাছে ধর্ষণের অর্থ দেশের স্বাধীনতার ওপর ধর্ষণ যৌন নির্যাতন দেশের নির্যাতনের সমর্থক’।

কারখানায় একজন নারী অনবরত মাইক্রোপিস সংযোজন করতে গিয়ে যখন চোখের দৃষ্টি হারায় বা দুষিত পানি ও খাবার বা যথাযথ স্যানিটেশনের অভাবে কর্মক্ষমতা হারায় তখন সে নিজের ঘর থেকেও বঞ্চিত। আর বৈদেশিক মুদ্রাঘাটতি পূরণের জন্য যখন দেশের কিশোরী ও তরুণীদের বানানো হয় পণ্যসামগ্রী তখন প্রশ্ন আসে নারীর সমমর্যাদা কি প্রতিষ্ঠিত।

বাংলাদেশের উন্নয়নশীল প্রক্রিয়ায় বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে দারিদ্র্যের বোঝা বহন করতে, ঘরে দিতে হচ্ছে বিনামূল্যে শ্রম, উৎপাদিত পণ্যের দাম পায় কম, কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা অনিশ্চিত নাগরিক কাজের ক্ষেত্রও সংকুচিত। ভূমি ব্যবহার ও মূলধন প্রাপ্তিতে তাদের প্রবেশাধিকার নেই, উৎপাদনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাতেও তাদের প্রবেশাধিকার নেই। যে পুঁজিবাদী সমাজে উন্নয়নে নারীর সস্তা শ্রমকে শোষণ করা হয়তেমন ব্যবস্থাকে জোরদার না করে উচিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের কারণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা যা শ্রেণি ও লিঙ্গবৈষম্যের জন্ম দেয়।

যে কোনো দেশে গণতন্ত্রের পরিমাপক হচ্ছে নারীর মর্যাদা। ইরানের নারী সমাজের যে দুঃখজনক অবস্থা এই শতকে দেখতে পাই তা কি নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে!

নারীর সমমর্যাদা অর্জনের জন্য প্রয়োজন নারীর পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, নিরাপদ ও নারীবান্ধব কর্ম পরিবেশ। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ও গুণগত মান বা সত্যিকার অর্থে মর্যাদা বৃদ্ধি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ও একই বিষয় প্রযোজ্য।

ব্যক্তির মর্যাদা, সমান সুযোগ, অনেক বিকল্প থেকে বেছে নেওয়ার সুবিধা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যূনতম নিরাপত্তা এগুলো ব্যক্তি ও সমাজের বিকাশের জন্য, একটি উন্নত রাষ্ট্রের জন্য, জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন এবং নারী এই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

সবচাইতে বেশি প্রয়োজন ব্যক্তি হিসেবে তার পরিপূর্ণ বিকাশ। নারী ও পুরুষ উভয়েই হবে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। হতাশার বেড়াজাল ছিঁড়ে অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তা অতিক্রম করে সব মানুষের সক্ষমতা বিকাশই হচ্ছে উন্নয়ন ও নারী পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। নারী দিবস পালনের যথাযথ উদ্দেশ্য তখনই বাস্তবায়িত হবে।

লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার কারিগর একজন নারী
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : মানবমুক্তির অমর ও অবিনাশী দলিল