আজ আন্তর্জাতিক গণিত দিবস। মার্চের ১৪ তারিখটি ইতিমধ্যে পাই দিবস হিসাবেও পরিচিত এবং বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয়। এটির নামকরণ করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা π (পাই) এর নামানুসারে যার মান ৩.১৪ এর কাছাকাছি। আমেরিকানদের তারিখ লেখার স্টাইল হচ্ছে আগে মাস আসবে এরপরে দিন। আমরা আগে দিন তারপর মাস লিখে থাকি। আমেরিকান নিয়মে আজকের তারিখ ৩.১৪.২০২২ খ্রিষ্টাব্দ। গণিতের ইউক্লিডীয় জ্যামিতির নিয়মে কোন একটি বৃত্তের পরিধি এবং এর ব্যাস এর মধ্যে অনুপাত সবসময় একটি ধ্রুবক সংখ্যা। আর এই ধ্রুব সংখ্যাটি হলো ‘পাই’। ১৯৮৮ সাল থেকে এই দিনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাই দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। তবে ২০২০ সাল থেকে এই দিনে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক গণিত দিবস পালন করা হচ্ছে।
এই দিবসটি গণিতবিদদের কাছে আরও একটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৮৭৯ সালের মার্চের ১৪ তারিখ বিশ্ববিখ্যাত নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার ২০১৮ সালের ১৪ ই মার্চ আরেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ স্টিফেন হকিং মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এতসব তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন- ইউনেস্কো পাই দিবস হিসেবে পালিত ১৪ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণিত দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ৪০ তম অধিবেশন দ্বারা সমগ্র বিশ্বের গণিতবিদদের জন্য ১৪ মার্চ তারিখটি আন্তর্জাতিক গণিত দিবস বা পাই দিবস হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী বছর আন্তর্জাতিক গণিত দিবস -এর উদ্বোধনী উদযাপনটি ১৪ মার্চ, ২০২০-এ হয়েছিল এবং এর থিম ছিল ‘গণিত সর্বত্র’। আমরা আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক কাজের প্রায় সব ক্ষেত্রেই গণিতের প্রয়োগ করে থাকি। বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে গণিত ছাড়া চলা প্রায় অসম্ভব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় সব ক্ষেত্রেই গণিতের ব্যবহার রয়েছে। আর বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণে মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের পাই দিবসের থিম ছিল ‘একটি উন্নত বিশ্বের জন্য গণিত’। গাণিতিক মডেল এবং পরিসংখ্যান বিষয় দুটি সাধারণত এপিডেমিক রোগের দ্রুত বিবর্তন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে এবং প্রশমন কৌশলগুলিকে অপ্টিমাইজ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিজ্ঞানীদের জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার। একটি উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গণিত যে ভূমিকা পালন করে তা মহামারী প্রতিক্রিয়ার বাইরে ছিলনা।
আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়ন ২০২২-এর মূল থিম নির্ধারণ করেছে: ‘গণিত একত্রিত করে’। মজার ব্যাপার এবারের থিমটি কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্র ইউলিয়া নেস্টেরোভা দ্বারা প্রস্তাবিত হয়েছিল। এর স্বপক্ষে যুক্তি ছিল ‘গণিত হল একটি সাধারণ ভাষা যা আমাদের সবার দরকার এবং একটি সাধারণ বিষয় যার সাথে একে অপরকে খুঁজে পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়ন (আইএমইউ) একটি অলাভজনক বৈজ্ঞানিক সংস্থা। যার প্রধান লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী গণিতের প্রচার ও প্রসার। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ করে। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ৯০।
এবার আমি পাই দিবসের ‘পাই’ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব। π প্রতীকটি এসেছে গ্রীক অক্ষর π থেকে, কারণ ‘পেরিফেরিচ-এর গ্রীক শব্দটি গ্রীক অক্ষর π দিয়ে শুরু হয়, যাকে আমরা আজ পরিধি বলি। π প্রতীকটি প্রথমে উইলিয়াম জোন্সের ১৭০৯ সালের লেখা এ নিউ ইনট্রোডাকশান টু ম্যাথামেটিক্স -এ দেখা যায় এবং চিহ্নটিকে পরে ১৮ শতকের মহান সুইস গণিতবিদ লিওনহার্ড অয়লার ১৭৩৭ সালের দিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। প্রায় ২০০ বছর পরে, ভারতীয় গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট ভগ্নাংশ ৬২,৮৩২/২০,০০০ সহ আনুমানিক π এর মান ৩.১৪১৬- সত্যিই একটি আশ্চর্যজনক অনুমান। ১৪০০ সালের দিকে, পারস্যের জ্যোতির্বিজ্ঞানী কাশানি π সঠিকভাবে ১৬ সংখ্যায় গণনা করেছিলেন।
পাই আসলেই একটি অনেক সুন্দর সংখ্যা। যারা পাই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছে তারা জানেন যে গণিতের যত ভিতরে যাওয়া যায় পাই এর সৌন্দরে্য ততই অবাক হতে হয়। আসলে পাই এর ইতিহাস আর গণিতের উন্নতি সাধনের ইতিহাস প্রায় সমসাময়িক। বিভিন্ন লেখকের পাই এর উপর লেখা ইতিহাস থেকে আমরা মোটামুটিভাবে তিনটি যুগের ধারণা পেয়ে থাকি। জ্যামিতির প্রয়োগে প্রাচীনকালের জ্যামিতিক যুগ, সপ্তদশ শতকে ক্যালকুলাস আবিষ্কারের পর সনাতনী যুগ, এবং কম্পিউটার আবিষ্কারের পর কম্পিউটার যুগ। সব বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত যে সব সময় সমান এবং তা ৩ উপরে তা প্রাচীন প্রায় সব উপমহাদেশের বিজ্ঞানীদের জানা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে প্রকাশিত বুকস অফ কিং- এ পাই এরমান হিসাবে ৩ প্রস্তাব করা হয়েছিল। আর্কিমিডিস প্রথম পাই এর গণনা করেন এবং এর একটি সীমা নির্ধারণ করেন । বৃত্তের ভিতর ৯৬ টি সুষম বহুভুজের পরিসীমা বের করে এ কাজটি করেছিলেন। যদিও দশমিকের পরে ট্রিলিয়ন ঘর পর্যন্ত পাই এর মান বের করা হয়েছে কিন্তু দশমিকের পর বারো ঘর পর্যন্ত ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। পাই এর সঠিক মান বের করার জন্য অনেকেই চেষ্টা করেছেন, এবং বর্তমানে সুপারকম্পিউটারকে ও কাজে লাগাচ্ছেন। যাই হোক পাই একটি অমুলদ সংখ্যা অর্থাৎ এটিকে দুটি পূর্ণ সংখ্যার ভগ্নাংশ আকারে লেখা যায় না। এটিকে দশমিক আকারে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব নয় কারণ এটিতে কিছু সংখ্যা পৌনঃপুনিক আকারে আসে। এতেই পাই এর আসল সৌন্দর্য। অর্থাৎ একটা পর্যায় থেকে কিছু অংক বারবার পর্যায়বৃত্ত হয়।
আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়নের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতি ও পাই দিবস পালনের বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই দিবসটি উদযাপনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে গণিত এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা ও গণিত ভীতি দূর করা। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে ভালো গণিত জানে ও বোঝে এরকম একটি প্রজন্ম তৈরি করা। আমাদের জীবনের সুন্দর সময় গুলো পর্যাবৃত্ত হতে থাকুক। সবার জীবন পাই মতো সুন্দর হোক।
লেখক : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।