আনন্দ আয়োজনের রাত এক লহমায় মৃত্যুপুরী

বেইলি রোডে আগুনে মৃত্যু বেড়ে ৪৬, হস্তান্তর ৪০ মরদেহ ভবনটিতে ছিল না রেস্তোরাঁর অনুমোদন, গ্রেপ্তার ৩

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ২ মার্চ, ২০২৪ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন তল্লাশি শেষ করে একে একে নেমে আসছিলেন রাত ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে, তখনও আগুনে পোড়া ভবনটির সামনে শত শত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। এর কয়েক ঘণ্টা আগেও বেইলি রোডের যে জায়গা ছিল জমজমাট এক আনন্দ আয়োজনের উৎসব স্থল সেখানে কারও মুখে কোনো কথা নেই। টুকরো টুকরো জটলায় কান পাতলেই শোনা যায়, এক আগুনে কী হয়ে গেল।

সাপ্তাহিক ছুটির আগের রাতে গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডের এ অংশের খাবার দোকানগুলোতে বরাবরই ভিড় থাকে। অধিবর্ষের এই রাতও ছিল অন্য এক রাতের মতই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর খাবারের স্বাদ নিতে কিংবা স্বজনদের সঙ্গে খাবার আনন্দ ভাগ করতে তারা এসেছিলেন ছোট ছোট দলে। সেই আনন্দ আয়োজন এক আগুনে পরিণত হয় বিষাদপুরীতে। আগুন কেড়ে নিল ৪৬টি প্রাণ, গুরুতর আহত হয়েছে আরও অনেকে। খবর বিডিনিউজের।

রাত পৌনে ১০টার দিকে হঠাৎ আগুনে শুরু হয় ছুটোছুটি। চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায় আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে। নিচ থেকে আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে ভবনের বিভিন্ন তলায় থাকা মানুষের বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এলোমেলো ছুটোছুটি শেষে সবাই গিয়ে জড়ো হতে থাকেন উপরের দিকে। এক পর্যায়ে নিচ থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুন আর ধোঁয়া থেকে বাঁচতে সবাই ভিড় করেন ছাদে। এরমধ্যেই ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের একের পর এক ইউনিট। এগুলোর কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আটকা ব্যক্তিদের উদ্ধারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। শুরুতে আগুন থেকে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে আহত ৫ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর খবর আসে। পরে আহত ও আগুনে দগ্ধ সেই সংখ্যা ১৫ হয়ে ৫০ ছাড়ায়। আগুন নেভানোর মধ্যেই নারী ও শিশুসহ জীবিত ৭৫ জনকে উদ্ধার করা হয়। ছাদে জড়ো হওয়াদের মধ্যে অচেতন অবস্থায় ৪২ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর তথ্য দেয় ফায়ার সার্ভিস। আগুন নেভানোর আগে প্রথমে ঘটনাস্থল থেকে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য আসে। এরপরই মৃতের সংখ্যা বেড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিভিয়ে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। এরপরই আসতে থেকে একের পর এক মৃত্যুর খবর। শেষমেষ রাতে ৪৪ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।

ভবনে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে একটি ভিডিওকে তদন্তের বড় আলামত হিসেবে দেখছে ফায়ার সার্ভিস। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ভবনে নিচ তলায় চাকফির দোকান ‘চুমুকে’ আগুন লেগেছে, আর তা নেভানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। ফায়ার সার্ভিস জানায়, একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। আগুনের সূত্র খুঁজতে গিয়ে এটি পাওয়া যায়। এটি স্থানীয় লোকজন দিয়েছে। এটি একটি সূত্র, তবে চূড়ান্ত নয়। তদন্তের সময় অনেকের সাথে কথা বলতে হবে, আরও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তারপরেই বলা যাবে প্রকৃত ঘটনা। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লেগে থাকতে পারে বলে ধারণার কথা বলেছেন।

শ্বাসনালি পুড়েই মৃত্যু বেশি : স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সাংবাদিকদের বলেন, যারা মারা গেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। যারা চিকিৎসাধীন তাদেরও প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে এবং সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার অনুমোদন ছিল না : এদিকে বাংলানিউজ জানায়, যে ভবনে আগুন লাগে সেটিতে রেস্তোরাঁ করার অনুমোদন ছিল না। ভবনটি শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রাজউক জানিয়েছে, ভবনটির অনুমোদন আটতলার। শুধু আটতলায় আবাসিক স্থাপনার অনুমোদন আছে। ভবনটির এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। তবে তা শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। রাজউক যেমন বলছে, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পোশাকের দোকানের অনুমোদন ছিল না, তেমনি ফায়ার সার্ভিসও বলছে, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

৪০ লাশ হস্তান্তর : অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৬ জনের মধ্যে থেকে ৪০ জনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৭ পর্যন্ত ওই ৪০ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহমান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ৪৬টি লাশের মধ্যে ৪০ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। তাদের সবাইকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আটজন ভর্তি আছেন। বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আটজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

গ্রেপ্তার ৩ : গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় অর্ধশত প্রাণহানির ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন ভবনটির নিচতলার চাকফির দোকান ‘চুমুক’র দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান রিমন এবং বিরিয়ানি রেস্তোরাঁ ‘কাচ্চি ভাই’র বেইলি রোড শাখার কর্মকর্তা জয়নুদ্দিন জিসান। এ ঘটনায় অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ডিএমপির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড
পরবর্তী নিবন্ধনাম লিখিয়েছিলেন সাংবাদিকতায়, এখন নিজেরাই খবর