আধুনিক যুগেও গুজবে হুজুগে বিভ্রান্ত মানুষ

সুপ্রতিম বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বৈশ্বিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভঙ্গুরপ্রায়। তবু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অনবরত অব্যাহত রেখেছে প্রতিটি দেশ ও বিশেষজ্ঞগণ। আবার আরেক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা গুজব ছড়িয়ে অন্যকে দিয়ে হুজুগে কিছু করিয়ে ফায়দা লুটার ধান্ধায় আছে। ইতিমধ্যে সে চিত্র আমরা মিডিয়ায় দেখেছি। বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গুজবের খবর বেশি লক্ষণীয়। যেখানে বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে ব্যর্থ; সেখানে অনেকের স্বপ্নে করোনা ভাইরাসের ঔষধ আবিষ্কারের গুজব ইউটিউব, ফেসবুকে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। এমনকি রাস্তায় রাস্তায় ঔষধ বিক্রির কথাও শোনা যায়। এই রকম গুজব রটনাকারীর সমর্থনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে মিথ্যার দিকে চালিত করার পায়তারা আগে যেমন ছিলো এখনো তা বিদ্যমান। এ এক আজব দেশ! গুজব ছড়াতে সময় লাগে না; আবার গুজবে কান দিয়ে হুজুগে কিছু করে ফেলতে সিদ্ধহস্ত। আমি, আপনি ও আমরা কি গুজব ও হুজুগের পিছনে দৌড়াই! কে কী বললো না বললো সেটা নিজ কানে শুনিনি, দেখিনি ও সেটার বিচারবিশ্লেষণ নেই, সত্যতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বরং মিথ্যা, মনগড়া কিছু বলে ফেললে সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে অন্যের গুষ্ঠি উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘নিজের খেয়ে অন্যের মহিষ তাড়ানো’ আমাদের অবস্থা বুঝি সেই রকম হয়েছে। গুজবে কান দিয়ে হুজুগে কিছু করে ফেললে কখনোই ভালো কিছু হয় না তা প্রায়শই হাড়েহাড়ে টের পাই। গুজব শুনে হুজুগে ধ্বংসাত্মক কিছু করে ফেলা অন্য কোন দেশে হয় না বলেই মনে হয়। বাঙালিরা এ দিক দিয়ে একধাপ এগিয়ে। শিক্ষিতঅশিক্ষিত উভয়েরই মাঝে গুজবে কান দিয়ে হুজুগে কিছু নেতিবাচক কাজ করার প্রবণতা লক্ষণীয়। তবে সচেতন যিনি তিনিই শিক্ষিত আর এই সচেতন মহল কোনদিনও কাউকে কখনো কানপড়া দেয় না এবং হুজুগেও কিছু করে না। কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত যারা তারা নিজের স্বার্থ উদ্ধারে কতিপয়ের মাঝে গুজব ছড়িয়ে হুজুগে ফায়দা লুটার ধান্ধায় থাকে। এই জায়গাটাই আমাদের বুঝি আরো বেশি সচেতন হয়ে উঠা প্রয়োজন। কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় বহু আগেই ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যকার গুজবের বাস্তব চিত্র ব্যক্ত করেছেন ‘ঐ নিয়েছে ঐ নিল যা! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে’। আমাদের গুজবে কান দেবার প্রবণতা যেন একটু বেশিই। গুজবে কান দিয়ে যদি চুপটি করে বসে থাকতো তাহলে না বুঝা যেতো কিন্তু ঐ যে হুজুগ নামক বায়বীয়ের প্রতি আসক্তি সেটা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আসল ঘটনার রহস্য উৎঘাটন না করে মিথ্যের পিছে দৌঁড়ে মরি। আর শেষে দেখি সবই পণ্ডশ্রম। এরই মধ্যে ক্ষতি যা হবার তা তো হয়েই গেল। ফলে অনেক সময় সত্যি সত্যিই কান হারাতে বসি। ফেসবুকে ও অন্যান্য মিডিয়ায় খুবই দ্রুত গতিতে গুজবের ডালপালা ছড়ায়। অনেক সময় এমন ঘটনাও ঘটে যে, যাকে নিয়ে পরিকল্পিত গুজবের রটনা সেই ব্যক্তিই গুজব সমন্ধে অবগত নন কিন্তু দেশের বাইরে তার সম্বন্ধে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আর একজন ব্যক্তি এই গুজবের বলি হলে তার পরিণাম কিই না ভয়াবহ! ধনুকের তীর ও মুখের কথা একবার বের হয়ে গেলে যেমন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়; তেমনি গুজব একবার ছড়িয়ে পড়লে তা তুলে আনা যায় না। গুজব ও হুজুগের ভয়াবহতা উপমহাদেশ তথা এ দেশের মানুষ অনেকবার অভিজ্ঞতা করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ৪৭এ দেশ ভাগের আগে ও পড়ে, ৭১এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, এমন কি এই আধুনিক যুগে এসেও গুজব আর হুজুগের বলি হতে হচ্ছে অনেককে। যে গুজব আর হুজুগে কান দিয়ে মানুষ অস্ত্রের খেলায় মেতেছে সে খেলা যেন শিশুর পুতুল খেলার মতোই সন্ধ্যায় আপনি আপন ঘর ভাঙার মতো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়গুজব ও হুজুগ কোনদিনই মানুষের জন্য মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনেনি এবং হলফ করে বলে দেওয়া যায় কখনো কোনদিন বয়েও আনবে না। গুজব আর হুজুগের ভয়াবহতা কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় যেন এই রকম, ‘সুধী সমাজ: শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি, যে জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই’। মুখরোচক খাবারের প্রতি মানুষের টান ও আকর্ষণ চিরদিনেরই। কিন্তু মুুখরোচক খাবার কোনদিনই মানব দেহের জন্য উপকারী নয়। এই ধরণের খাবার মুহূর্তে মানুষের শরীরের ক্ষতি না করলেও ধীরে ধীরে স্বল্পায়ুর দিকেই নিয়ে যায়। গুজব যেন সেই মুখরোচক খাবারের মতোই। বেশির ভাগ মানুষের কাছে তা প্রিয়। তবে ক্ষতির পরিমাণ অপরিমাপযোগ্য। গুজব রটানোর মানুষের যেমন অভাব থাকে না তেমনি গুজব শুনে হুজুগে কিছু করে ফেলার লোকের সংখ্যাও কম নয়। গুজব যেন ‘বাতাসে তাড়িত তুষের মতো’। একটু প্রশ্রয় পেলেই গুজব তুষের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব ছড়ানো যেন দিনকে দিন শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছে। একবার যদি কোন বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে যায় তাহলে তা আর রোধ করা যায় না। ফলে ক্ষতি যা হবার তা হয়েই যায়। ডিজিটাল মাধ্যমে গুজবের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ণ করেছেন। এই আইন প্রণয়ণ ডিজিটাল গুজবকে কতটুকু রোধ করতে পারবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে কিন্তু একটা থেকেই যায়আইন করে না হয় ডিজিটাল গুজব রোধ করা গেল; মানুষের অস্থিমজ্জায় যে গুজব আর হুজুগ নামক বিষ বাড়ে তা কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে! তবে এটা বলা যায় যে, সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি ও সামাজিক সচেতনতাই গুজবকে রোধ করতে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই গুজব ও হুজুগ হতে সাবধান! কারণ আপনার ছড়ানো গুজবে পড়ে হুজুগে অনেকে বুঝে না বুঝে ব্যক্তি, পরিবার, ও দেশকে রসাতলে নিয়ে যেতে পারে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতীয় কবি
পরবর্তী নিবন্ধএকটি দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও প্রাসঙ্গিক বিষয়-আশয়