আদবের বাদশাহ : নজির আহমদ শাহ

খুরশীদ আনোয়ার | শনিবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ

হজরত হাফেজ নজির আহমদ শাহ মাইজভান্ডারীয়া তরিকার এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ খলিফা। তিনি হজরত গাউছুল আজম গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারীর (প্রকাশ বাবাজান কেবলা কাবা) একজন যোগ্য ও সফল খলিফা। তাঁকে মাইজভান্ডার দরবার শরীফের আওলাদে পাক, মুরিদানে মাইজভাণ্ডারীয়াগণ আদবের সম্রাট হিসেবে সম্মান করতেন এবং এখনো সবার মুখে মুখে এ প্রশংসা প্রচলিত আছে।

হজরত নজির আহমদ শাহ শিক্ষাগত যোগ্যতায় একজন প্রসিদ্ধ হাফেজে কোরআন এবং প্রথম জীবনে আলমে শরিয়তের একজন নিবিড় ও একনিষ্ঠ পায়বন্দ ছিলেন। শরিয়তের হুকুমআহকাম, জীবনবিধান, রসূলে করিম (.) এর আদর্শে এবং নীতিতে জীবন পরিচালনা করতেন। এ জন্যে এই অলি ‘জামালে মোস্তফা’ লকব অর্জনে সফলতা অর্জন করেন।

প্রথম জীবনে তিনি বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) একটি শহরের জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি পদব্রজে নিজ জেলা চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।

পরিশ্রমের আধিক্যে তিনি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েন। পারিবারিক জীবনে তিনি পটিয়া থানার জুলধা গ্রামের বাসিন্দা। সমভ্রান্ত পরিবারের সদস্য হবার পরও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অহংকারশূন্য, স্বল্পভাষী ছিলেন। তাঁকে উচ্চ স্বরগ্রামে কথা বলতে কেউ কখনো শোনেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিশোর বেলায় তাঁকে অত্যধিক এবং অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে শুনিনি।

প্রথম জীবনে তিনি হালিশহরের প্রখ্যাত দ্বীনে শরিয়ত হজরত হাফেজ মুনির উদ্দীন (রহ🙂 ছাহেবের এর মুরিদ ছিলেন। হাফেজ ছাহেব তাঁর মুরিদকে ভীষণ ভালোবাসতেন।

কোন এক সময়ে হাফেজ মুনির উদ্দীন (রহ🙂 ছাহেবের পীরে কামেল হজরত আজমগীরী ছাহেব ভারতের আজমগড় থেকে চট্টগ্রামে মুরিদের আস্তানায় তসরিফ আনেন। মৌলনা হাফেজ মুনির উদ্দীন (রহ🙂 খুশি হয়ে তাঁর মুরিদ নজির আহমদ ছাহেবের সঙ্গে তাঁর পীরের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, নজির আহমদ একজন পরহেজগার এবং আমার মুরিদদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এ যুবক তুলনা রহিত এবং কর্মিষ্ঠ।

অনেকক্ষণ চুপ থেকে আজমগীরী ছাহেব স্বীয় মুরিদ হাফেজ মুনির উদ্দীন (রহ🙂 ছাহেবকে বলেন, ‘এটা অনেক শক্তিমান ঘোড়া, তাঁর ওপরে ছওয়ার হওয়া সহজ কাজ নয়। তুমি তাঁকে ছেড়ে দাও।’

তথন থেকেই বোঝা গিয়েছিলো, তিনি কোনো সাধারণ যুবক নন।

এমতাবস্থায় মনোক্ষুণ্ন ও হতাশ হয়ে হাফেজ নজির শাহ বাড়ি ফিরে আসেন।

নজির শাহ বিয়ে করেছিলেন প্রখ্যাত আলেমে তরিকত মৌলানা হজরত আমানত উল্লাহ শাহ (কে🙂 এর জ্যেষ্ঠ কন্যাকে।

উল্লেখ্য, হজরত আমানত উল্লাহ শাহ মাইজভান্ডারীয়া তরিকার প্রবর্তক শাহ সূফি সৈয়দ আহমুদুল্লাহ শাহের মুরিদ ও খলিফা ছিলেন। সেই সূত্রে তাঁর শ্বশুর ছাহেব একদিন জামাতাকে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ ঘুরে আসার অনুরোধ করেন। শ্বশুর ছাহেবের অনুরোধে তিনি পায়ে হেঁটে দরবার শরীফ গমন করেন। তরীকতে মাইজভান্ডারের কিছু কিছু ছিলছিলা পছন্দ না হওয়ায় অভুক্ত অবস্থায় নজির আহমদ শাহ শ্বশুর বাড়ি ফিরে আসেন।

সেই দিন পড়ন্ত বেলায় অতি পরিশ্রমের কারণে না নেয়ে, হালকা খেয়ে শুয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঘুম ভেঙে তিনি তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বলেন, ‘আমার ছাতা লাঠি দাও, ভাণ্ডার শরীফ যাবো। এক্ষুণি বাবাজান আমাকে ডাকছেন।’

কারো কথা না শুনে তিনি হন্তদন্ত হয়ে অনেকটা বেহুশি অবস্থায় ভান্ডার শরীফ রওনা হয়ে যান। সে সময় বাবাজান (কে🙂 আলম জীবিত ছিলেন। তখনকার দিনে কোনো বিশেষ যানবাহন না থাকার কারণে দীর্ঘসময় তিনি পায়ে হেঁটে মাইজভান্ডার গিয়ে পৌঁছেন। পৌঁছেই কোনো দিকেই ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি বাবজানের হুজরা শরীফের দিকে সাক্ষাৎএর উদ্দেশ্যে উপস্থিত হন।

বাবাজান তাঁকে দেখামাত্র ঈষৎ হাসেন এবং কালাম করেন, ‘যাও আপনা এলাকামে যা কের রাজ করো।’

ঠিক তখনি হজরত নজির শাহের এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। তিনি যেন এক পলকে আরশেমহল্লা দেখতে পান। বাবাজান স্মিত হেসে তাঁকে বিদায় করে দেন। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, মানুষ এখনো দরবার শরীফকে আউলিয়া বানানোর কারখানা মনে করে। বাবাজান কখনো কাউকে দস্তেবায়েৎ করার প্রয়োজনবোধ করতেন না। এমনও দৃষ্টান্ত আছে বাবাজানের এক পলক নজরে কারম যার ওপর পড়েছে সেই ভাগ্যবান মূহুর্তেই অলি হয়ে গেছেন।

এটাই শাশ্বত এবং অকাট সত্য। নজির আহমদ শাহ ঠিক একই দর্শনে আ’লা অলি ও উচ্চ মর্যাদার খলিফা। হজরত ও বাবাজানের যত খলিফা ছিলেন তাঁদের সবার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও আশেকি সম্পর্ক ছিল। নিজের জীবনকে তিনি এমন সাধারণভাবে পরিচালনা করেছেন যা বহু আলেমে তরিকতের অনুসারীদের কাছে অকৃত্রিম দৃষ্টান্ত হিসেবে এখনো প্রতিষ্ঠিত। দৈনন্দিন জীবনে তিনি ছিলেন স্বল্পহারী এবং অনাড়ম্বর বসবাসে অভ্যস্ত। তিনি প্রায় সময় মুরাকাবা মুশাহেদা ও গভীর ধ্যানে নিমজ্জিত থাকতেন। রাতে বেশির ভাগ সময় তিনি ইবাদত করে নির্ঘুম কাটাতেন। ঘরের পরিবার পরিজনদের মধ্যে তাঁকে অনেকেই জিকিরকরা অবস্থায় শূন্যে ভাসতে দেখেছেন। এমনও দেখা গেছে কোনো কোনো রাতে তিনি ঘর থেকে আসন ছেড়ে উধাও হয়ে যেতেন সবাইকে ঘুমের ঘরে রেখে। একবার নজির শাহ এর বড় নাতনি হঠাৎ দেখতে পায় নানাজান বিছানায় নেই, বিছানা শূন্য পড়ে আছে। তাঁকে সবাই ঘুমাবার সময় ঘুমাতে দেখেছে এবং মধ্যরাতে এ কান্ড দেখে তাঁর নাতনিতো হতবাক। উপায়ন্ত না দেখে সে কিশোর নাতনি ফের ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় খুব ভোরে সবাই প্রাত্যহিক ঘুম ভেঙে উঠে দেখে তিনি সটান নিঃশব্দে ঘুমাচ্ছেন। এ কান্ড দেখে নানাকে প্রশ্ন করার পরে নানা মুখে আঙ্‌গুল রেখে এ বিষয়ে কাউকে না বলবার জন্য নাতনিকে বারণ করে দেন। কিন্তু এসব বিষয়তো কখনো চাপা রাখা যায় না।

সেই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কী জীবিত কী ওফাৎ পরবর্তী সময়ে অসংখ্যা ভক্ত অনুরক্ত তাঁর কেরামত প্রত্যক্ষ করে নানান অসুখে শেফা পায় এবং হাজত মকসুদ পূরণ হয়। এভাবে কউমে নজির ভান্ডার বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন তার ওরশ মোবারকে প্রচুর মুরিদান, ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটে।

আজ ১৩ই জানুয়ারি তাঁর বার্ষিক ওরশ মোবারক মহাসমারোহে পাঠানটুলীস্থ নজীর ভাণ্ডার দরবার শরীফে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই আদবের সম্রাট মহান অলি দুই পুত্র ও তিন কন্যার জনক। তাঁর বড় শাহজাদার নাম হজরত শাহ সূফি সৈয়দ শামসুল হুদা আল মাইজভাণ্ডারী ও কনিষ্ঠ জনের নাম শাহজাদা সৈয়দ মৌলানা আখতার কামাল শাহ।

পাঠানটুলীতে তাঁর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘হাফেজ নজির আহমদ শাহ হাফেজীয়া, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ।

কিশোর বেলায় তাঁর উপস্থিতিতে অনেক কেরামত দেখবার সুযোগ হয়েছে। আশা করছি, পরবর্তী বছরে ইনশাআল্লাহ বেঁচে থাকলে তাঁর উল্লেখযোগ্য কেরামতসমূহ লিখে পাঠক সমীপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।

লেখক : কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধজনগণ ও গণতন্ত্রের বিজয় সুসংহত থাকুক