ঘুমাতে পারিনি বেশ কয়েক রাত। আশে–পাশের মানুষগুলো যেদিকে পারছে ছুটোছুটি করছে। মানুষের ছুটোছুটি দেখে আমার ছোট বাচ্চা আহ’ইয়ান কান্নাকাটি করছে। আমার স্ত্রীর স্কুল যেখানে ছিল সেই ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে আগুন লেগেছে। লস অ্যাঞ্জেলসের সবদিকে আগুন। দাবানলে ১০ একরের ওপরে যে স্থানে আগুনে জ্বলেছে, সেটাই বেশি ফোকাস হয়েছে। কিন্তু এখানে ছোট বড় মিলে ১২৪টা স্থানে আগুন লেগেছে। এই পর্যন্ত অন্তত ২০ জন মারা গেছেন, ৪০ হাজার ৫৪৮ একর জায়গা, ১২ হাজার ৩শ’ স্থাপনা সম্পূর্ণ জ্বলে গেছে। নিউ ইউর্কের পরে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরে এবারের আগুনে ২০০ বিলিয়নের উপরে ক্ষতি হয়েছে বলে আবহাওয়া অফিস ধারণা করছেন। পরে হয়তো এটা বাড়তে পারে। এটা এই শহরের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সর্বোচ্চ রেকর্ড। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন, এখানে খাবার পাওয়া যাচ্ছে কিনা, খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ আছে কিনা, দামের কি অবস্থা। অবাক হওয়ার বিষয় এখানে এই জিনিসগুলির বিন্দুমাত্র এদিক ওদিক হয়নি। সবকিছু স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মত সুযোগ বুঝে কেউ স্টক করেনি কিংবা দাম বাড়িয়ে মুনাফা করেনি। শত শত বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়–ক্ষতির পরেও উন্নত প্রযুক্তি ও শক্তিশালী অর্থনীতি একটা দেশের মানুষকে কতটা সাহস দিতে পারে তা এখানকার মানুষের মনোবল না দেখলে বুঝা যাবে না। স্বপ্ন দেখি কখন আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে এরকম একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারবে। কখন আমার দেশের মানুষ শত বিপদে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর আস্থা রাখতে পারবে। কখন আমাদের দেশের মানুষ তার মনবলের জন্য সত্যিকার একটা শক্তির উৎস খুঁজে পাবে। আমাদের দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন থেকে একটু এদিক সেদিক হলে মিডিয়া যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে কালোবাজারি থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাই মুনাফার জন্য পাগল হয়ে যায়। সরকারও দিশেহারা হয়ে যায়। উন্নত প্রযুক্তি যেমন প্রতি মুহুর্তে কোন এলাকা এখন জ্বলছে, কোন এলাকা কত ঝুঁকিপুর্ণ, কোন এলাকা ঝুঁকিমুক্ত, কোন এলাকায় আশ্রয় নেবেন সব আপডেট আপনি পাচ্ছেন। অন্যদিকে সরকার কিংবা ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলা অভয় দিচ্ছেন যাতে মানুষ তাদের মনোবল না হারায়। ব্যাংকগুলি আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে সহজ শর্তে সবাইকে ঋণ দেওয়া হবে কিস্তি শুরু হবে স্বচ্ছল হওয়ার পরে। আমার কাছাকাছি যে আগুন সেটা সানসেট– হলিউড। খুব কাছে হওয়াতে আগুনের কি ক্ষমতা তা যেমন বুঝতে পারছি ঠিক তেমনি খুব ক্ষমতাধর মনে করা মানুষগুলি কত অসহায় তা নিজে উপলব্ধি করছি। অস্কার বিজয়ী নামীদামী নায়ক– নায়িকাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, রাস্তা পরিস্কার করে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার জন্য দামী ব্রান্ডের গাড়ি গুলি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর মোবাইলে অ্যালার্ট ম্যাসেজ বেজে ঊঠছে। আগুন কত কাছে চলে আসছে লাইভ ওয়েবসাইটে দেখছি। চারিদিকে ছাই আর পোড়া গন্ধে নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলে কত করুণ হতে পারে তা বুঝিয়ে বলা খুব কঠিন। আমরা মানুষ এবং দেশ হিসাবে অবস্থান কিংবা সময়ের কারণে অনেকে অনেক সময় খুব ক্ষমতাশালী মনে করি। কিন্তু গত কয়েকদিনে আমেরিকার মত ক্ষমতাশালী দেশের জনপ্রিয় মানুষগুলির করুণ আর্তনাদ এবং অসহায়ত্ব দেখলে বুঝতে পারবেন সৃষ্টিকর্তার চেয়ে ক্ষমতাশালী আর কেউ নেই। মানুষ সেখানে কিছুই না। বড় অসহায়। আমরা প্রায় সময় এই কথা ভুলে যাই বলে সৃষ্টিকর্তা নানাভাবে সেটা আমাদের দেখিয়ে দেয়। মানুষ এতই আত্মঅহংকারী দুদিন পর সেটা আবার ভুলে যায়। ভুলে যাই আল্লাহতায়ালা ‘কুন ফায়া কুন’ বললে যেমন যে কোনো কিছু সৃষ্টি হয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবে যে কোনো সময় যে কোনো দেশ বা সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুক।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আইটি বিশেষজ্ঞ