জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ জন আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিশোরী বলে জানা গেছে। তাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে পরীক্ষায় ফেল করা কিংবা আশানুরূপ ফল না করাকে দায়ী করা হয়। অন্যদিকে, ২৮ জানুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সারা দেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এই সমীক্ষার তথ্য বলছে, আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪০ জন বা ৬৪ শতাংশই স্কুল পর্যায়ের। এছাড়া কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সমমান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী এই এক বছর আত্মাহুতি দিয়েছেন বলে উঠে এসেছে আঁচলের সমীক্ষায়। শুক্রবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা : সমাধান কোন পথে?’ শীর্ষক এই সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী জানান, দেশের দেড় শতাধিক পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের তথ্য নেওয়া হয়েছে তাদের এই সমীক্ষায়। দেশের আট বিভাগে আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে, যা মোট আত্মহত্যার প্রায় ২৩.৭৭ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রামে ১৭.২৭ শতাংশ। এর পর রয়েছে যথাক্রমে রাজশাহী ১৬.৮১ শতাংশ, খুলনা ১৪.১৩ শতাংশ রংপুর ৮.৭৪ শতাংশ, বরিশাল ৮.৫৩ শতাংশ, ময়মনসিংহ ৬.২৭ শতাংশ ও সিলেট ৪.৪৮ শতাংশ।’
কিন্তু কেন বাড়ছে আত্মহত্যা? এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ইদানীং পড়ালেখা ও ফলাফল নিয়ে আগের চাইতে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পড়াশোনা এখন পরিণত হয়েছে অস্থির সামাজিক প্রতিযোগিতায়। যেখানে মা–বাবা সন্তানের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক সম্মান রক্ষার হাতিয়ার বলে মনে করেন। অভিভাবকদের এই অতি প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাভিলাষের কারণেই বোর্ড পরীক্ষায় পাস না করায় কিশোর কিশোরীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে বলে তাঁরা জানান।
বয়ঃসন্ধিকালের এই সময় কিশোর কিশোরীদের প্রতিনিয়ত পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় ছেড়ে দেয়ার ফলে তাদের মধ্যে হতাশা অবসাদের মতো জটিল মানসিক টানাপোড়েন শুরু হয়। এ অবস্থায় তাদের শুধু পাঠ্যবইয়ের চাপে না রেখে সৃজনশীল কাজের প্রতি উৎসাহিত করার পরামর্শ দেন সমাজবিজ্ঞানীরা। ভালো ফল দিয়ে নয় বরং মানবিকতার চর্চায় যারা আজ সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন সেসব ব্যক্তিত্বের উদাহরণ দিয়ে সন্তানদের অনুপ্রেরণা দেয়ার তাগিদ দেন তাঁরা।
শুধু মনোচিকিৎসক কিংবা মনোবিজ্ঞানী নয়, সবাই মিলে দায়িত্ব নিলে অনেকাংশে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, নিজের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা আসতেই পারে। তখন কিছু কাজ করলে অন্যের সাহায্য ছাড়াও আত্মহত্যা অনেকাংশে প্রতিরোধ সম্ভব। এক্ষেত্রে আত্মহত্যার ওয়ার্নিং সংকেতগুলো চিনতে হবে। নিজের ইতিবাচক চিন্তাভাবনাগুলো খাতায় লিখে তালিকা করে বারবার দেখতে হবে। সামাজিক সম্পর্ক বাড়ানো প্রয়োজন, বিশেষ করে যারা বিপদের সময় সহায়তা করতে পারবেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। পরিবার বা কাছের মানুষের সঙ্গে শেয়ার করা। নিজের পরিবেশকে আত্মহত্যার উপকরণমুক্ত করা। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে মানসিক স্বাস্থ্য প্রফেশনালদের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
গবেষকরা বলছেন, মানসিক চাপই আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। প্রতিনিয়ত আমরা এমন অনেক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করছি, যারা মানসিক চাপে থাকে, অথচ আমরা তা বুঝতে পারি না বা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না– এ যন্ত্রণা থেকে কীভাবে মুক্তি পেতে পারে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে আত্মহত্যা রোধে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা সময়ের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে মানসিকভাবে শক্ত করা যাবে, মনকে দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। যে কোনো সমস্যা বা অপ্রাপ্তিতে হতাশ না হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।