আত্মহত্যার বিষয়টি যতটা না মানসিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঠিক ততটাই পারিবারিক বা সামাজিক। সমাজবিজ্ঞানী, নৃ–বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মনে করেন, প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা সমাজ, সংস্কৃতি এবং সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। একজন মানুষের আত্মহত্যার পিছনে আমাদের পারিবারিক বা সামাজিক দায় কখনোই এড়িয়ে যেতে পারি না।
গবেষণায় দেখা গেছে, সব শ্রেণি–পেশার মানুষ আত্মহত্যা করলেও কিশোর–কিশোরীও যাদের বয়স ৩৫–এর নিচে তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
বর্তমান পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজে মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং পরিতৃপ্তির মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের চাওয়া এবং পাওয়ার মধ্যে সমতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু একজন ব্যক্তি যা চায়, সমাজ হয়তো তার সবটুকু দিতে অপারগ। কেননা, সমাজে বিদ্যমান সম্পদের মাধ্যমে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এ–কারণে ব্যক্তি সমাজের উপর আস্থা হারায়, যার ফলে সমাজে বিভিন্ন আত্মহত্যা ঘটমান।
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বা সমাজকর্মীরা এই আত্মহত্যা রোধ করার জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন।
সবার ধারণা এমনই হয় যে ব্যক্তি যখন তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে হতাশায় থাকে তখনই আত্মহত্যা করে। আবার অনেকের ধারণা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, পারিবারিক কলহ কিংবা আর্থিক সংকটও আত্মহত্যার পেছনে দায়ী। তবে যেহেতু আত্মহত্যা সামাজিক ঘটনাগুলোর অংশ তাই অবশ্যই এটার একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আছে। সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মহত্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তবে, এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় সবচেয়ে যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত আলোচনা করেছেন এমিল ডুর্খেইম। এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যা সম্পর্কে তার “ঝঁপরফব” গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।
তাঁর মতে, ব্যক্তির মধ্যে তিনটি কারণে আত্মহত্যা ঘটছে–আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা, পরার্থমূলক আত্মহত্যা, নিয়মনীতিহীন বা নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা।
এমিল ডুর্খেইমের মতে আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। তিনি সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক সচেতনতার সঙ্গে আত্মহত্যা সম্পর্ক নিরূপণ করেছেন।
আত্মহত্যা প্রসঙ্গে অ্যারোন বলেন, আত্মহত্যা হলো আত্মহত্যাকারী কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ঘটনা যা মৃত্যু ঘটায়। তাই বলা যায় আত্মহনন করা তথা নিজের জীবন নিজের দ্বারা নিঃশেষ হওয়া হলো আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা প্রসঙ্গে ডুর্খেইম আরও বলেন, যারা সমাজের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত তারা আত্মহত্যা করে। আবার যারা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন তারাও আত্মহত্যা করে। এ কারণে বিভিন্ন ধরনের আত্মহত্যার ধারণা দেন।
সারাবিশ্বে প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন সফলভাবে আত্মহত্যা করছেন।
কেউ নিজের জীবনকে শেষ করে ফেললেই আত্মহত্যা। জীবনের আয়ু ফুরিয়ে যাবার আগেই যদি নিজেকে গুটিয়ে নেয়া হয় সেটিই আত্মহত্যা।
বিদ্যমান আইনে আত্মহত্যা কোন অপরাধ না হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করা অপরাধ। কেউ আত্মহত্যা করে নিহত হলে আইন তো আর তাকে শাস্তি দিতে পারবে না। তবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে আইন তাকে ঠিকই সাজা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
সমাজে বা পরিবারে দেখা যায়, কোনো ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির পারস্পরিক মনোমালিন্য হলে আত্মহত্যা করার হুমকি দিচ্ছেন। তাঁর আত্মহত্যার প্রবণতা না ভীতি প্রদর্শনের প্রবণতা রয়েছে, সেটা একপ্রকার মানসিক ব্যাধি। এই প্রবণতা দূর করার জন্য তাঁকে অবশ্যই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আবেগপ্রবণতা, মাদকাসক্তি বা মানসিক অসুস্থতার কারণে অনেক সময় এসব প্রবণতা দেখা দেয়। তবে এটাও ঠিক যে অনেক ক্ষেত্রেই কেউ কেউ আবার আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অন্য কোনো ব্যক্তির প্ররোচনাতে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে আত্মহত্যায় প্ররোচনার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০২৩)-এর ৯ক ধারায় নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনও নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনও কার্য দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে আত্মহত্যা করলে, ওই নারীকে অনুরূপ কার্য দ্বারা আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে বলা হবে।
আত্মহত্যার প্ররোচনায় শাস্তি সংক্রান্ত আইন
বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়ার অপরাধে শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে এমন অভিযোগ এনে দায়ের করা মামলায় শাস্তিদানের ঘটনা বিরল। আত্মহত্যার প্ররোচনায় বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ৩০৬ ধারা অনুযায়ী, ব্যক্তির আত্মহত্যায় প্ররোচণায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা। তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেও যদি ঐ ব্যক্তি মারা না যান তবে প্ররোচনা দানকারী ঐ ব্যক্তির ১ বছরের জেল হতে পারে।
যতজনই প্ররোচনা দিয়ে থাকেন না কেন প্ররোচনাদানকারী সবাইকেই আইনের আওতায় আসতে হবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত সবাইকেই তাদের ভূমিকা বা অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে।
তাছাড়া সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ৩২ ধারায় বলা আছে, আত্মহত্যাকারীর মৃত্যুর আগে রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট প্ররোচনা দানকারীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। তবে শুধু একটি সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। সুইসাইড নোটের সমর্থনে আরও সাক্ষ্য–প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।
সেক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে কোনো মনোমালিন্যের সূত্র ধরে তিনি যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটান, তবে অবশ্যই আপনি আইনগত জটিলতার মুখোমুখি হতে পারেন। তীব্র অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, উত্তেজিত করার মাধ্যমে কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া দেশের আইন অনুযায়ী একটি অপরাধ। তবে অভিযোগের সমর্থনে সাক্ষ্য–প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে কারও বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা গেলে তখনই শাস্তি প্রদান করা যাবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া বা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনো কাজ দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে কোনো নারী আত্মহত্যা করলে তা আত্মহত্যার প্ররোচনার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। যার জন্য সে ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হবে।
এছাড়াও আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে সেই ব্যক্তিকে আত্মহত্যা করার অপচেষ্টার অপরাধে এক বছরের জেলে যেতে হতে পারে। দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারামতে, যদি কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নেন এবং অনুরূপ অপরাধ করার উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করেন, তা হলে তাঁর এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে বা উভয় শাস্তিই হতে পারে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, চট্টগ্রাম।