আত্মমগ্ন কবি-শিল্পী-গীতিকার অধ্যাপক আবু জাফর

আবু সাঈদ হান্‌নান | মঙ্গলবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র ‘ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার’ উপলক্ষ্যে অধ্যাপক আবু জাফরকে দেয়া প্রশংসাপত্রে উদ্ধৃত করে– ‘আমাদের প্রতীতি এতটুকুকবিতা রচনা, সংগীত সাধনা, গীতসৃজন, সংগীতের নবতর মূল্যায়ন, ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুবাদ, প্রবন্ধ রচনায় সমাজের হিতসাধন, মানবকল্যাণ ও ধর্মে নিষ্ট থেকে জীবনবোধের উজ্জীবন তাঁর মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ বিচারে যথেষ্ট বিবেচিত হবে।’ বহুপ্রজ আত্মমগ্ন লেখক কবি শিল্পী গীতিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবু জাফর। সব্যসাচী এ লেখক তরুণ তুর্কী অবস্থায় দু’হাতে লিখেছেন, বলেছেন, গেয়েছেন সুরারোপ করেছেন। তুলে এনেছেন সোঁদামাটিপ্রজ মেটেল সুর, ঝংকার তুলেছেন দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গানে। নতুনভাবে রূপায়ন করেছেন লালন গীতিকে। জীবনের মুকুলিত প্রহরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মহান মুক্তিসংগ্রামে। ওপার বাংলার বুদ্ধিজীবীমহলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে রেখেছেন অসামান্য অবদান। যৌবনে দেশসেবায় ব্রতী এ গুণীজন অহরাত্র ব্যয় করেছেন সংগীত সাধনায়। একের পর এক স্বরলিপি রচনা করে ভরিয়ে তুলেছেন গানের খাতা।

বেতার এবং টেলিভিশনের নিয়মিত গীতিকার, সুরকার এবং তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন অধ্যাপক আবু জাফর।

. ‘এই পদ্মা এই মেঘনা,

এই যমুনা সুরমা নদী তটে

আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়’

. ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকা দি’র নাম’

সে এখন ঘোমটা পরা কাজল বধু

দূরের কোন গাঁয়,

. ‘গল্পের শেষ আছে

যেতে যেতে একদিন

নদীও সাগরে গিয়ে মেশে

শুধু হৃদয়ের অনুরাগ শেষ হবে না

জন্ম ভূমিকে ভালোবেসে,

. আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখিনি

ক্লিওপেট্রা কি মমতাজকেও নয়

এমন বহু জনপ্রিয় গানের গীতিকার ও সুরকার এ গুণিজন। বাংলার পললভূমের নরম নকশা এঁকেছেন তিনি গীত এবং সংগীতে। তাঁর গানের বাণী, সুর ও চিত্রকল্প এক কথায় অসাধারণ। দেশপ্রেম, মানবিকতা ও প্রকৃতিসংলগ্নতা তার গানের প্রধানতম অনুষঙ্গ। আবু জাফরের সোঁদামাটির ঘ্রাণে বিমোহিত আত্মপরিচয় বিধৃত গানগুলো স্বাধীনতাত্তোর সময়ে নতুন পথ চলার প্রেরণা যুগিয়েছে। আবু জাফর তার ‘এই পদ্মা এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে/আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়’ এবং গল্পের শেষ আছে/ যেতে যেতে একদিন/নদীও সাগরে গিয়ে মেশে/শুধু হৃদয়ের অনুরাগ শেষ হবে না /জন্ম ভূমিকে ভালোবেসে’ গানসমূহে দেশপ্রেম এবং দেশজ সুরের যে বয়ান তিনি উপস্থাপন করেছেন তা আবু জাফরকে বাংলা সংগীতাঙ্গনে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে। তার গানের চিত্রকল্প যেমন– ‘এই অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুঁয়ে/ নির্ভয়ে নীলাকাশ রয়েছে নুঁয়ে।’ এ গান নদী, সবুজ বাংলার অবারিত সবুজের

বন্দনা তার স্বদেশ প্রীতির প্রোজ্জ্বল উদাহরণ। আবু জাফর নদী ও নারীকে দেখেছেন একাকার করে। তাঁর ‘গল্পের শেষ আছে/ যেতে যেতে একদিন/নদীও সাগরে গিয়ে মেশে/শুধু হৃদয়ের অনুরাগ শেষ হবেনা /জন্ম ভূমিকে ভালোবেসে’ এই গানে দেশ মাতৃকার যে নখাদ এবং নির্মোহ প্রেমের প্রকাশ পেয়েছে তা সত্যিই অবর্ণনীয়। আবু জাফর ‘তোমরা ভুেলই গেছো মল্লিকা দি’র নাম’ গানে গ্রাম্য কিশোরীর চরিত্রের মাধ্যমে শৈশব প্রীতি ও গ্রাম বাংলার শ্যামলিমার নকশি কাঁথা এঁকেছেন আপন মহিমায়। প্রকৃতি প্রেমের পাশাপাশি মানবমানবির প্রেম প্রতীয়মান করা একজন কবি ও শিল্পীর অনন্য শৈল্পিক সত্ত্বা। আবু জাফর তার ‘ আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখিনি’ এবং ‘ নিন্দার কাঁঠা যদি না বিঁধিলো গায়ে/ প্রেমের কী স্বাদ আছে বলো’ জাতীয় গানের মধ্য দিয়ে নির্মল প্রেমের যে দৃশ্যপট এঁকেছেন তা একজন শিল্পীকে পরিচিতি দানে অনন্য জহুরীর মর্যাদা। বিশেষ করে ‘আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখিনি’ গানে চিরায়ত নারী বন্দনার সাথে বর্ণনা দিয়েছেন ভূগোল, ইতিহাস আর বৈশ্বিক প্রেমের রসায়নের। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেকে পরিচিতি দিয়েছেন -‘গীতপতঙ্গ’ বলে। বলতে চেয়েছেন– ‘প্রথম তারুণ্যে প্রেমে পড়ার চেয়েও গানই ছিলো আমার সকল অভিমান ও অনুরাগের কেন্দ্রবিন্দু’ আবু জাফরের গানের সম্ভার ঋদ্ধ হয়েছ্‌ে তাঁর.হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল ২. আমার নিকৃষ্ট গান ৩. বাংলা গানের সুখদুঃখ ৪. বাজারে দুর্নাম তবু তুমি সর্বস্ব ৫. বিপ্লোত্তর সোভিয়েত কবিতা’ ইত্যাদি গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথের গানকবিতা, জীবনানন্দ, লালন ও বৈষ্ণবপদাবলীর সাথে সাথে হাফিজ, রুমি ও ইকবালে বুঁদ হয়ে থাকতেন যৌবনে।

আবু জাফর শুধু লিখেই দায়িত্ব শেষ করেননি। সমান তালে সুর করেছেন এবং গেয়েছেন একক ও দ্বৈত কণ্ঠে। লালন সম্রাজ্ঞাী ফরিদা পারভিনের সাথে ছিলো তার গানের ও প্রাণের রসায়ন। সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হওয়ায় বিশ্বমানের কবি ও সাহিত্যিকদের প্রতি ছিলো প্রগাঢ় অনুরাগ। কিন্তু আল্লামা ইকবালের প্রতি ভালোবাসার পারদ ছিলো তার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে। তার কারণ হিসেবে আবু জাফর তার ‘কবি ও নকীব’ গ্রন্থে বলেন

কবি ইকবালের প্রতি আমার অনুরাগদৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে প্রধানত দু’টি কারণে। প্রথমত, উপমহাদেশীয় মুসলিম উম্মাহর করুণ অবস্থা ও অবস্থানের প্রেক্ষাপটে ইকবালের সাহসী ভূমিকা ও নির্ভুল দিকনির্দেশনা; এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর কথা ও কাব্যের ব্যবহারিক বাস্তবতা।

প্রথমটি রাজনৈতিক, দ্বিতীয়টি কাব্যভাবনামিশ্রিত। (কবি ও নকীব; ভূমিকা)

অধ্যাপক আবু জাফরের খেরোখাতায় শুধু গীতবয়ানই নয়, হীরকখণ্ডরূপে লুকিয়ে আছে দেশ, সমাজ, বিশ্বসাহিত্য ও মানবতা বিষয়ক বহু প্রবন্ধনিবন্ধ। এসব প্রবন্ধে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজরাষ্ট্রের অসারতা, তারুণ্যের জয়গান ও বিপদগামিতা। তাঁর তুলির আঁছড়ে মূর্ত হয়েছে নীতিবোধ, কল্যাণকামিতা এবং ভবিষ্যতের পথ চলার দীপশিখা। অধ্যাপক আবু জাফর সচেতনভাবে কলম ধরেছেন নিগৃহীত নিষ্পেষিত মানবতার কল্যাণব্রতী হয়ে।

অধ্যাপক আবু জাফর জীবনের মধ্যগগণে অনুধাবন করেনঐশী চেতনা এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহামানবের জীবনেই রয়েছে মানবজীবনের পরম পাওয়া। আর সেই বোধ থেকেই তিনি একাধারে রচেছেন মহামানবের জীবনী, আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেছেন জীবনের অন্বিষ্ট পাথেয় সংগ্রহে। তাঁর সকল প্রেম ও মনোযোগ, সকল চিন্তা, আনুগত্য ও অনুরাগ একমাত্র মহান রবের সন্তুষ্টি তালাশে।

নোঙর বিংশসংখ্যায় সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তিনি বলেন– ‘আমি একজন আত্মমগ্ন মানুষ, আমার দৃষ্টি ভবিষ্যৎমুখি। আর এই ভবিষ্যৎ পার্থিব নয়, পারলৌকিক ভাবনা দ্বারা আচ্ছন্ন। পার্থিব জীবনের সফর তো প্রায় শেষ হতে চললো। আখেরাতে আল্লাহপাক আমাকে কীভাবে গ্রহণ করবেন, সেটাই এখন সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তার বিষয়। খ্যাতি ও অর্থবিত্তআহরণ আমার কাছে কোনো মূল্য বহন করে না। আল্লাহপাক বলেন– ‘ওয়া রিদওয়ানুম মিনাল্লাহি আকবার জালিকা হুয়াল ফাউজুল আজীম’আল্লাহর সন্তুষ্টিই জীবনের শ্রেষ্ঠতম সাফল্য। (সুরা তাওবা/৭২) অতএব অন্য সকল দিক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি মনোযোগী হওয়াই যে কোন মানুষের অবশ্য কর্তব্য। (নোঙর কুড়িতম সংখ্যা; জৈষ্ঠ্য ১৪২০ বাংলা)

আবু জাফর মনে করতেন জীবনের নানাবিদ অনুষঙ্গ আমাদের ‘কিছুতেই স্থির, অবিচল ও আত্মমনস্ক হতে দিচ্ছে না।’ তাঁর এতটুকু বুঝ ছিলো যে– ‘এ থেকে পরিত্রাণের একটিই মাত্র উপায়, এবং তা হলো শত ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও আত্মপরিচয় ও নিজস্ব অভিজ্ঞানকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরা, নিঃশর্তভাবে ইসলামের কাছে ফিরে আসা।’ এবিষয়ে তার অসামান্য বোধসংশ্লিষ্ট বই ১. তুমি পথ প্রিয়তম নবী তুমিই পাথেয় ২. ইসলামের শত্রু মিত্র ৩. ইসলাম ও আত্মঘাতী মুসলমান ৪. মহানবীর (সাঃ) মহাজীবন ৫. অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় সত্য কথা।

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান অধ্যাপক আবু জাফর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন শিক্ষকতায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক আবু জাফর অধ্যাপনা দিয়েই তাঁর কর্মজীবনের সমাপ্তি টানেন।

লেখক: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ‘সাহিত্যের কাগজ কাঞ্চী’,

নির্বাহী সম্পাদক; লিটল ম্যাগাজিন ‘নোঙর’

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনা দরকার
পরবর্তী নিবন্ধজয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টা মামলায় খালাস পেলেন মাহমুদুর রহমান