২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হেড নেক অনকোলজিক সোসাইটিজ এই দিবসকে নির্বাচন করে এবং তা প্রতিবছর নিয়মিত পালন করে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হেড নেক অনকোলজিক সোসাইটিজ (ওঋঐঘঙঝ) হল বিশ্বের সকল দেশের হেড নেক ক্যান্সার সোসাইটিগুলোর সম্মিলিত প্লাটফর্ম।বিশ্ব হেড-নেক ক্যান্সার দিবসে ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা, কি কি কারনে বা অভ্যাসে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে? কিভাবে এ অভ্যাস থামানো যায়? ক্যান্সারের উম্মত্ততা কিভাবে বন্ধ করা যায়? এ রোগের প্রতিরোধের জন্যে কি কি করা যেতে পারে? গণমানুষের ক্যান্সার বিষয়ে সাধারণ ধারণার প্রসার, একেবারে শুরুতেই রোগ নির্ণয় করা, এ রোগের যথাযথ চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা এবং চিকিৎসার ফলাফল ইত্যাদির ব্যাপারে আলোকপাত করা হবে।
আমেরিকার নিউইয়র্কে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই বিশ্ব হেড-নেক ক্যান্সার দিবস এর ঘোষণা অনুষ্ঠানে লেখক এর সাথে হেড-নেক ক্যান্সারের কিংবদন্তি সার্জন অধ্যাপক জে পি সাহা ও অনুষ্ঠানের দুই উপস্থাপক-হলিউড অভিনেত্রী ও ঈঘঘ এর উপস্থাপক।
দুই : ক্যান্সারের ব্যাপকতা
এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে প্রতি ছয়জনের মৃত্যুর মধ্যে এক জনের মৃত্যু ক্যান্সারের কারণে হয়েছে এবং বিশ্বে ক্যান্সারে কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি দুইজনে একজন তাদের জীবদ্দশায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এতে পুরুষের সংখ্যা মহিলাদের দ্বিগুণ। গত দশকে এ সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। আশংকা করা হচ্ছে আগামি এক দশকে এ সংখ্যা দেড়কোটিতে পৌঁছবে যার আনুমানিক দু’তৃতীয়াংশ হবে উন্নয়নশীল দেশে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ । বাংলাদেশে ক্যান্সার এর ব্যাপকতা ঠিক কতটা তার যথাযথ পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। আনুমানিক ২০ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশে রয়েছে। প্রতি বছর আনুমানিক ২ লাখ মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি বছর আনুমানিক ১ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছ্েন। সে হিসেবে আমাদের দেশে প্রতিদিন এ মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে ২৭৩ জন মানুষ- দি ডেইলি স্টার ১০ জানুয়ারী ২০২২।
তিন : হেড-নেক ক্যান্সারের ব্যাপকতা
কোন ক্যান্সারে কতজন আক্রান্ত যাচ্ছেন সে দিকে আমরা একটু আলোকপাত করব। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্যান্সার রেজিস্ট্রি নেই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ন্যাশনাল ইন্সিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ এন্ড হসপিটাল এর সর্বশেষ প্রকাশিত (২০১৫-২০১৭) রিপোর্ট অনুযায়ী সর্বাধিক আক্রান্ত ক্যান্সার হল পুরুষের জন্যে ফুসফুস ক্যান্সার এবং মহিলাদের জন্যে স্তন ক্যান্সার। এখানে হেড-নেক ক্যান্সার এর বিভিন্ন অংশ আলাদাভাবে হিসেব করা হয়েছে। হেড-নেক ক্যান্সার বলতে শরীরের যে অংশের ক্যানসার বুঝায় সেগুলো হল মুখ ও মুখ-গহবরের কান্সার, থাইরয়েড ক্যান্সার, নাকের ক্যান্সার, সাইনাসের ক্যান্সার, কণ্ঠনালীর ক্যান্সার, গলনালির ক্যান্সার, শ্বাসনালীর ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার, নানা রকম লালাগ্রন্থির ক্যান্সার, হেড-নেক এর ত্বকের ক্যান্সার, হেড-নেক এর লসিকাগ্রন্থির ক্যান্সার ইত্যাদি। আলাদা আলাদা ভাবে অবস্থানে পুরুষের সারণী দেখা যাচ্ছে প্রথম দশটি ক্যান্সারের মধ্যে পুরোপুরি দুটি এবং অংশত আরও দুটি হেড-নেক ক্যান্সার। মহিলাদের সারণী দেখা যাচ্ছে প্রথম দশটি ক্যান্সারের মধ্যে পুরোপুরি একটি এবং অংশত আরও দুটি হেড-নেক ক্যান্সার। অর্থাৎ হেড-নেকে আক্রান্ত সব ক্যান্সার এর যোগফল ন্যাশনাল ইন্সিটিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ এন্ড হসপিটাল এর সর্বশেষ প্রকাশিত সারণী তে সর্বাধিকের কাছাকাছি। এর বাইরে থাকছে থাইরয়েড ক্যান্সার। আন্তর্জাতিক হিসাবে দেখা গেছে, অর্ধেক জনগোষ্ঠীর থাইরয়েড রোগ রয়েছে এবং এর দশভাগের একভাগ থাইরয়েড ক্যান্সার এ আক্রান্ত। থাইরয়েড ক্যান্সার এর প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা প্রধানত সার্জারি বা অপারেশন। এবং আরও গভীরতর (অফাধহপবফ) থাইরয়েড ক্যান্সার এর চিকিৎসায় সার্জারি ছাড়াও নিতে হয় রেডি ও একটিভ আয়োডিন থেরাপি। এই থেরাপি দেয় নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগ। এই বিপুল পরিমাণ রোগী প্রথাগত ক্যান্সার হাসপাতালে যায় না স্বাভাবিক কারণে। এজন্যে এ রোগীগুলো ন্যাশনাল ইন্সিটিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ এন্ড হসপিটাল এর সর্বশেষ প্রকাশিত (২০১৫-২০১৭) রিপোর্ট এ উল্লেখিত হয়নি। নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগের থাইরয়েড ডিভিশন এর সাথে কথা বলে জানা যাচ্ছে দেশের নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগের সব সেন্টারগুলোতে বছরে আনুমানিক ২২০০-২৩০০ রোগী থাইরয়েড ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে আসেন। থাইরয়েড ক্যান্সারের সব রোগীও কিন্তু এখানে আসেন না । বিশেষত প্রাথমিক পর্যায়ের থাইরয়েড ক্যান্সারের রোগীরা। কারণ তাদের এই থেরাপির দরকার হয় না। তাছাড়া গভীরতর থাইরয়েড ক্যান্সারের রোগীদের কেউ কেউ অপারেশনের পর এখানে রিপোর্ট করতে বললেও আসেন না। অবহেলা করেন সব মিলিয়ে আমি মনে করি, যদি সঠিক ভাবে হিসাব করা হয়, সব হেড-নেক ক্যান্সার এর সম্মিলিত সংখ্যা সর্বাধিক হবে আমাদের দেশে।
চার : সরকারি ও বেসরকারি পরিষেবা : কষ্ট ও ভোগান্তি
হেড-নেক ক্যান্সারে আক্রান্তের ফলে মানুষের কি নিদারুন কষ্ট এবং তার চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষের কি পরিমাণ ভোগান্তি তা আমরা সবাই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি না। একমাত্র ভুক্তভোগিরাই তা কেবল উপলব্ধি করতে পারে। দেশে এ রোগে আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ খুবই অপ্রতুল। রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা পাওয়া অনেকটা দুঃসাধ্য। অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা সুবিধা নাই। সরকারিতে খুবই চাপ এবং অত্যধিক ভিড়। প্রয়োজনীয় জনবল এবং অবকাঠামোর অভাব। একেকটি বড় হেড-নেক সার্জারিতে ৮/১০ ঘণ্টা সময় লাগে। সারাদেশে এ রোগের বিশেষায়িত অপারেশন করেন আনুমানিক ২৫ জন মাত্র । বিভিন্ন কারণে রোগীরা আসেন দেরীতে গভীরতর রোগ নিয়ে। চিকিৎসার মাধ্যমে এদের সারিয়ে তোলা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপারেশন পরবর্তী রেডিওথেরাপির অবস্থাও খুবই ভয়াবহ। রোগীর তুলনায় সেন্টার এর সংখ্যা অনেক কম। রেডিওথেরাপি শুরু করতে অনেক দেরি হয়। এতে করে হয়ত রোগ আবার ফিরে আসে নয়ত কেমোথেরাপির যন্ত্রণায় পড়ে। হেড-নেক ক্যান্সারের বিশেষ কষ্ট ও ভোগান্তি হল, এটি শরীরের এমন এক অংশে হয় যা দৃশ্যমান। গভীরতর ক্যান্সারগুলো দ্রুতই মানুষের চেহারায় বিকৃতি আনে এবং কষ্টদায়ক গন্ধ ছড়ায়। সুমধুর কণ্ঠ বিনষ্ট করে। খাদ্যগ্রহণ বন্ধ করে দেয়। সমাজ ও পরিবার তাকে আর স্বাভাবিক জীবনে গ্রহণ করতে পারে না। অপরপক্ষে একটু সতর্ক থাকলে এ রোগ একেবারে প্রথমেই ধরা পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ের হেড-নেক ক্যান্সারের চিকিৎসা খুবই সহজ। খরচ কম। ফলাফল অত্যন্ত ভাল। এসব কারণে দ্রুততার সাথে চিকিৎসা নেয়া দরকার।
পাঁচ : আশার কথা
-নেক সার্জারি ডিভিশন ২০১০ সালে চালু করা হয়েছে। প্রায় বিনামূল্যে চিকিৎসা হচ্ছে। সমপ্রতি চিকিৎসকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে এক বছরের ফেলোশিপ চালু করা হয়েছে। কিভাবে এসব হাসপাতালের মাধ্যমে উপায়হীন রোগীদের আধুনিক সেবা নিশ্চিত করা যায় তার জন্যে আরও বেশি চিন্তা-চেষ্টা করতে হবে। কাজ করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতকে ধারন করে। বেসরকারিতেও উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। নতুন সেন্টার হচ্ছে। রেডিওথেরাপি মেশিন বসছে। কিন্তু খরচ অনেক বেশি। এগিয়েছি বটে কিন্তু যেতে হবে আরও অনেক দূর।
ছয় : প্রতিরোধে কি করণীয়?
আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বে এক কোটির বেশি মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। প্রতি ৫ জনের মধ্যে ৩ জন প্রাথমিক উপসর্গগুলো উপেক্ষা করছেন যা না করলে তাদের সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। যতই চিকিৎসা সুবিধা থাকুক ক্যান্সার একবার হলে এর অনেক কষ্ট। এ জন্যে প্রতিরোধই হল সর্বোত্তম। সাধারণ খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন। চর্বি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খাবেন। ফলমূল ও সবজির পরিমাণ বাড়ান। ধূমপান সম্পূর্ণ ত্যাগ করুন। মদপান পরিহার করুন। মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশ দূষণ পরিহার করুন। পান-তামাক বর্জন করুন। পরিশীলিত যৌন জীবন যাপন করতে হবে। পরিপূর্ণ ক্যান্সার রেজিস্ট্রি চালু করা সময়ের দাবী। নিয়মিতভাবে পরিবর্তনশীল চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। গলাফুলা, মুখে ঘা, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, খেতে কষ্ট, নাকে রক্ত পড়া ইত্যাদির ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। সময়মত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ভাল থাকুন।
লেখক : অধ্যাপক, নাক কান গলা ও হেড এন্ড নেক সার্জারি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা