আজাদী অফিসে গেলেই বাদল ভাইয়ের কক্ষে ঢুঁ না মেরে আসা যেত না। সাথে চা। স্পষ্টভাষী ঋজু এই মানুষটিকে আজাদী অফিসে আর পাবোনা সেটিই এখন বাস্তবতা। কিন্ত ভুলে কি যাবো? আমি আজাদী অফিসে এরপর গেলে জীবনের বাস্তবতায় বাদল ভাইয়ের চেয়ারে হয়তো অন্য কাউকে দেখবো। কিন্তু আমি দেখবো না বাদল ভাইকে।
বাদল ভাই ছিলেন সোজা কথা বলার মানুষ। ঢাকাইয়া ঢংয়ে কথা বলতেন। মজা করে বলতাম দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ, ঢাকাইয়া হতে চান? উত্তরে বলতেন, ‘আরে ভাই ঢাকা টাকা না এটি বাংলাদেশের ভাষা বলেন, ভারতের টিভিতে দেখেননা বাঙাল চরিত্রের মুখে আমার ভাষা।’ আসল কথা বলতে কাউকে পরোয়া করতেন না।অন্যদিকে ছিলেন সদালাপী ও তুমুল আড্ডা প্রিয় এক মানুষ। সত্তর দশকের ঢাকা শহরের বর্ণনা, জীবনাচরণ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতে পারতেন। উত্তরাধিকারসূত্রে ধমনীতে টগবগ করা জমিদারি রক্ত ধারণ করা এই মানুষটি কাউকে ছোট করে দেখতেন না। অসম্ভব ক্রীড়াপ্রেমী এই মানুষটির কক্ষে যখন যেতাম তখন সামনে রাখা টিভি সেটে চলছে কোনো না কোনো স্পোর্টস চ্যানেল।
ক্রিকেট ফুটবল সব খেলার ব্যাকরণগত দিক সমৃদ্ধ ছিল তাঁর জ্ঞান ভাণ্ডার। ধূমপান করতেন। এই বিষয় নিয়ে আলাপ করতে গেলে হা হা করে হেসে বলতেন জীবনে আছে কি? সবচেয়ে বড়কথা তাঁর মধ্যে ছিল শিশুর সারল্য। আজাদীকে ভালোবাসতেন। খুব শ্রদ্ধা করতেন আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে। ওয়াহিদ মালিক ভাইকে প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। নিজের কর্মস্থল আজাদীকে তিনি উপাসনালয়ের মতো ভালোবাসতেন। আড্ডায় বসলে জীবনের নানা বাঁকের অভিজ্ঞতার কথা শুরু করলে থামতে চাইতেন না। সমৃদ্ধ ছিল জ্ঞান ভাণ্ডার। সমৃদ্ধ ছিল তাঁর অভিজাত সংগ্রহ। আজাদীতে বাদল ভাইয়ের অফিসকক্ষে ঢুকলেই চোখে পড়বে ষাট দশকের টেলিফোন সেট, শুরুর দিককার মোবাইল সেটসহ অনেক প্রাচীন প্রতীক। ব্যক্তি জীবনে কোনো ধরনের হা–হুতাশ ছিলনা, ছিলনা না পাওয়ার অতৃপ্তি। জীবনকে তিনি উপভোগ করতেন। হেসে হেসে পাল্টা যুক্তি দিতেন তখন যখন তাঁকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতাম। বিকেলে হাঁটার নিয়মিত অভ্যাস ছিল। জামালখানের মোড় বা ডিসি হিলের কাছে হাঁটা অবস্থায় দেখা হলেই সালাম ও হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাঁর কক্ষে রক্ষিত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্বাক্ষরিত একটি ব্যাট দেখে আমার ছেলে সাকিবকে খুব পছন্দ করে বলতেই বাদল ভাই বলে উঠেছিলেন, ‘আরে মিয়া ওর জন্য সাকিবের স্বাক্ষর করা একটা ব্যাট আমি এনে দেব’ কেবল ভালোবাসার মানুষরাই এই ধরনের কথা বলতে পারেন। সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন তিনি।
আজাদীকে খুব খুব ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন আজাদী সংশ্লিষ্ট সকলকে। বাদল ভাই নাই এই কথা আমার লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছাই শেষ কথা। তবে দৈনিক আজাদী এক আজাদী অন্তপ্রাণ মানুষকে হারালো।
আমরা হারালাম এক প্রিয় মানুষকে। ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয় বাদল ভাই। আজাদী অফিসে আপনাকে আর দেখবোনা, কিন্ত আজাদী আপনাকে আজীবন মনে রাখবে এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক : ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক