দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের আজ মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কর্মজীবন শুরু হওয়ার কথা ছিল শিবপুরে। তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে সেখানে খুব লোভনীয় বেতনে তার চাকরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। মা ও মাতৃভূমির টানে তিনি ফিরে এসেছিলেন দেশেই, ততদিনে প্রচার হয়ে যায় চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। চাকরির প্রস্তাব আসতে থাকে চারদিক থেকে, এমনকি রেঙ্গুন থেকেও। অবশেষে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে চাকরি নেন। তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে। চাকরি জীবনের প্রথম থেকেই তিনি নিষ্ঠা ও সততার পরিচয় দিতে শুরু করেন। শ্রম ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি কর্মক্ষেত্রকে পবিত্র করে তুলেন। প্রথম থেকে তিনি নিজের চাকরিস্থলের প্রতি ছিলেন ত্যাগ নির্ভর। তিনি বিশ্বাস করতেন চাকরির প্রতিটি সময়কে যদি নিষ্ঠার সাথে ব্যয় করা না যায়, সে বেতন হালাল হবে না। তাছাড়া তখন চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ উন্নয়নের প্রাথমিক অবস্থা। মাত্র ৫–৬ বছর চাকরি করেই তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা হয়ে ওঠেন। সহযোগী তড়িৎ প্রকৌশলী থেকে তিনি ক’বছরে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হয়ে যান। পরে কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান প্রকৌশলীর পদ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন চাকরি করেননি। মূলত ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি চাকরির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিশ্বাস করেন নি যে, তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। কর্তৃপক্ষ আর্থিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিসহ তাকে আরো বড় পদ দিতে চাইলেন। কিন্তু না, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হঠলেন না। তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পরহিতব্রতে নিজেকে অধিকতর জড়িয়ে রাখার মানসে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার তাঁকে বিদ্যুৎ বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি সেই প্রস্তাবও বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি ততদিনে নিজেকে স্বাধীন ব্যবসায় নিয়োজিত করেছিলেন।
চাকরিতে থাকাবস্থায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর লাইব্রেরি, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ইঞ্জিনিয়ার খালেক কোহিনূর লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল বই পড়ার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল চট্টগ্রাম শহরের প্রথম বিদ্যুৎ চালিত প্রেস। আবদুল খালেক নিজেই মেশিনম্যানদের মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তৎকালীন।
মুসলমান শিল্পী সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশনায় তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা করতেন, অনুপ্রেরণা জাগাতেন। এছাড়া মুসলমান শিল্পী সাহিত্যিকদের দ্বারা পত্র পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রয়োজনে তিনি আর্থিক সাহায্যও প্রদান করতেন। মননশীল সাহিত্য সংকলন প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর কোহিনূর প্রেস ছিল উল্লেখযোগ্য। এ সময় তিনি নিজেও লেখক ও সাহিত্য সেবী মানুষে পরিণত হন। একই সাথে তিনি প্রকাশকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়ে নিজের মনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা স্পৃহাগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেন। তাঁর পরিচালিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় পুস্তিকা ‘কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’– কী অসাধারণ সাহস থাকলে বাঙালি বিদ্বেষী পাকিস্তান সরকারের হিংস্রতার সময় একটি প্রেস এমন সাহসী ভূমিকা নিতে পারে।
কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসকে ঘিরে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার লেখার ও লেখকের একটি আলাদা জগত তৈরি করেন। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে মুদ্রিত ‘কোহিনূর মঞ্জিল’ থেকে আবদুল খালেক কর্তৃক প্রকাশিত এবং কোহিনূর লাইব্রেরি কর্তৃক পরিবেশিত ১৯৫৭ সালে প্রথম প্রকাশিত তাঁর ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ জীবনী পুস্তকের শেষ পৃষ্ঠায় ১০টি গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়। এর মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র নাথ, শেখ এ চাটগাম কাজেম আলী, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ১৯৩০, বার আউলিয়া ও নেপোলিয়ান– এই ৬টি গ্রন্থ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক রচিত। বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, তিনি আশির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। উল্লিখিত ৬টি ছাড়া আরো ১১টি গ্রন্থের নাম পাওয়া গেছে। এগুলো হলো, প্রাথমিক ভূগোল, বিজ্ঞান ও গ্রাম্য জীবন, রচনার প্রথম ছড়া, উর্দু প্রাইমার, বয়েস ইংলিশ গ্রামার, ফাস্ট বুক অব ট্রান্সলেশন, চাইল্ড পিকচার ওয়ার্ড বুক, ব্যাকরণ মঞ্জুষা, তাওয়াফ (হজ্বের বই), ঝলমল (শিশুপাঠ), মুসলিম বাল্য শিক্ষা এবং সহজ পাঠ (শিশুপাঠ্য)।
সাংবাদিক জীবনে তাঁর দুটি ধারাবাহিক উদ্যোগ রয়েছে : সাপ্তাহিক কোহিনূর ও দৈনিক আজাদী। সাপ্তাহিক কোহিনূরের আত্মপ্রকাশ ১৯৫০ সালের ২২ ডিসেম্বর। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক আপন আলোয় এ সমাজকে, সমাজের মানুষকে, রাষ্ট্রকে আলোকিত করতে চেয়েছেন। তাঁর সে স্বপ্ন আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে, চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক আজাদী ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ সাধনেও দৈনিক আজাদী’র ভূমিকা অপরিসীম। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদী স্বাধীনভাবে লেখনী চালিয়েছে। এ মহান ব্যক্তিত্ব তাঁর জীবৎকালে দেখিয়ে গেছেন মানবমুক্তি এবং সমাজমুক্তির লক্ষ্যে কাজ করাই সাংবাদিকদের প্রকৃষ্ট পথ। ১৯৬২ ত্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতার টেবিলেই অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। আজাদী এখন গৌরবের ৬৬ বছরে পদার্পণ করেছে। তাঁর আদর্শ অক্ষুণ্ন রেখে এগিয়ে চলছে আজাদী।