দৈনিক আজাদী। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক আজাদী। সেই ছোটবেলা থেকে যুক্ত পত্রিকাটির সাথে আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে। আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার আমার নানা। আমার নানী আঞ্জুমান আরা বেগমের বড় বোন মালেকা খাতুনের স্বামী। আমরা তাঁকে বড়নানী ডাকতাম। আজাদীর সূচনাকালে আমার জন্ম হয়নি। কিছুকাল পরে জন্ম এবং ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে যখনই অক্ষরজ্ঞানের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম,বাল্য শিক্ষা পাঠ ‘ ঘোড়ায় চড়িল, আছার খাইলো, আবার উঠিল নড়িয়া পড়িল’ কিংবা ‘দুষ্টমতি লংকাপতি/হরে নিল সীতা সতী/ রামচন্দ্র গুণধর/বধিলেন লঙ্কেশ্বর’ এই সব পড়া মুখস্থ’ করার সাথে সাথে দেখতাম ঘরে আজাদী আসতো নিয়মিত।
এটি ষাটের দশকের গোড়ার কথা। অন্য পত্রিকাও আসতো, সেগুলোর কথা মনে নেই। তবে মা বেগম পত্রিকা পড়তেন নিয়মিত। আমিও চোখ বুলাতাম, একটি সুন্দর বাচ্চার ছবি থাকতো প্রতি সংখ্যায় ভেতরের পাতায়। আবার সেলাই ফোঁড়, রান্নাবান্না , এসব থাকতো, মা আর আপা পড়তেন মনোযোগ সহকারে।
দিন গড়িয়ে যায় , সখ্য গড়ে উঠে আজাদীর সাথে, ইত্তেফাকের সাথে, সংবাদের সাথেও। তবে আজাদী জড়িয়ে যায় আষ্টেপিষ্ঠে। লেখালেখি করে নয়, পাঠক হিসাবে। শিশুকাল থেকে এই পর্যন্ত দীর্ঘকাল ধরে আছি আজাদীর সাথে। আজাদীর সাথে রয়েছে নানান স্মৃতি। কোনটা ফেলে কোন টা লিখি দিশেহারা। আজাদী আমার বাবার মৃত্যুর খবর ছাপে সেই কতোকাল আগে। বাবার মৃত্যুর আগে আমরা টানা ১৮ দিন আন্দরকিল্লাহস্থ’ আজাদী অফিসের তিনতলায় আমার মালেক মামার বাসায় ছিলাম। নীচের তলায় প্রেস, আর পত্রিকা অফিস। খালেদ মামা (মোহাম্মদ খালেদ) সম্পাদক, মালেক মামা পরিচালনা সম্পাদক। তেতলায় উনাদের বাসা টি এতো সুন্দর ছিল। বড় লন, তার চারপাশে নানান ফুলের গাছ। কামিনী, গোলাপ , শিউলি , হাস্নাহেনার সুবাসে যেন স্বর্গীয় এক পরিবেশ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল
একটি পোষা ময়না পাখি। যে কিনা কথা বলতে পারতো। পাখিটি দরজার সামনে একটি খাঁচায় বন্দী থাকতো। আমার বড় নানী ( মালেক মামার মা) আর খালারা মামাকে পুরো নাম ধরেই ডাকতেন। পাখিটিও তা শিখে যায় । অবিকল মানুষের মতো সে আবদুল মালেক, আবদুল মালেক করে ডাক দিতো। আর আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। অবোধ পাখি কিভাবে মানুষের মতো কথা বলে! এদিকে সন্ধ্যায় কামিনী শিউলি আর গোলাপের সুবাসে খোলা অলিন্দ আর রাতের
আকাশ কি সুন্দর লাগতো। হাজার তারার মিটিমিটি দেখতাম, দেখতাম নক্ষত্ররাজির ঝিকিমিকবিচরণ।
রাতের আকাশ দেখতাম তেতলার উঠোন থেকে। নীচে পত্রিকা ছাপা হতো। μমাগত মেশিনের শব্দ শুনতাম। জীবনে প্রথম ছাপাখানা দেখা, একটি একটি অক্ষর শীষা দিয়ে তৈরি, যারা কাজে করছেন, তারা নীচে বোধ হয় শুকাতে দিতেন, পরিষ্কার মনে নেই। কি বড় বড় কাঠের বাক্সের মতো। শাদা শাদা শীষার অক্ষর সব। তবে খুব সকালে ঝকঝকে তকতকে পত্রিকা ঘরে আসতো। আমিও চোখ বুলাতাম হাতে নিতাম, তবে কি পড়তাম , তা খুব একটা মনে নেই। এরপর আমাদের জীবনের ট্র্যাজিডি শুরু। আমার বাবার মৃত্যু। সেই বাড়ি থেকে আমাদের করুণ প্রত্যাবর্তন। এতো ছোট ছিলাম মনে নেই সব কথা। মনে পড়ে মালেক মামার একটি কালো প্রাইভেট কার ছিল, সেই গাড়িতেই আমরা গহিরা স্কুলে বাবার কোয়ার্টারে আসি। পরের দিন অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে বাবার মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়। তবে ১৮ দিন আমার বাবার হাসপাতালে চিকিৎসা , মৃত্যুর পরে আমাদের নিয়ে যাওয়া, জানাজা, লাশ দাফন সব কিছুতেই আমার মালেক মামা আর খালেদ মামা উনারা দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ভিন্ন চিত্র। কিন্তু আজাদী পরিবারের স্নেহ আর মমতা থেকে আমরা বঞ্চিত হইনি। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে । পেশাগত কারণে যদিও আমি পূর্বকোণ এর সাথে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু আজাদী আমার সাথে , আমার পরিবারের সাথে, আমার আত্মর সাথেই ছিল প্রোথিত। চাকরি পূর্বকোণে হলেও নিয়মিত লিখেছি আজাদীতে। উপ সম্পাদকীয়,মহিলা মাহফিল, সাহিত্য পাতা কিছুই বাদ নাই। অরুণদা কে লেখা দিয়ে আসতাম । তিনি ছাপতেন যত্ন সহকারে।
ফাহমিদা আপা মহিলা মাহফিল দেখতেন, উনার লেখাও অরুণ দা নিতেন। μমান্বয়ে সোনালীর তত্ত্বাবধানে নারী পাতা, আজমিশালীতে কত কত লেখা তার হিসাব নেই। আমার অনার্স পরীক্ষা আর মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট আজাদীতে ছাপা হয়। তখন নামসহকারে রেজাল্ট পত্রিকায় ছাপাতেন। মনে পড়ে অনার্সে কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট আসলে খালেদ মামা আমার মাকে টিএণ্ডটি তে ফোন করে অভিনন্দন জানান। আমার রেনু খালাম্মা (মিসেস খালেদ) ইকবাল হোেেটলের মিষ্টি নিয়ে আসেন।
আমি আমার মালেক মামা মামীকে সালাম করতে গেলে আমাকে ক্যাশ টাকা দেন, যার মূল্য এখন অন্েক। এরপরেও অনেক কথা। সারাজীবন কোহিনুর লাইব্রেরি থেকে আমাদের জন্য নতুন বই চলে আসতো। আর কি সুন্দর সুন্দর বাাঁধাই করা খাতা আসতো প্রেস থেকে , যা নিয়ে আসতেন কোহিনূর প্রেসের ম্যানেজার চান্দুমামা । (লোকমান হাকিম) ।
আর পত্রিকাও পেতাম সৌজন্য কপি। আজ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেক কথাই মনে পড়ছে। আমি ৯৩ সালে পরিবেশ বিষয়ক ফেলোশীপ নিয়ে ভারতে গিয়েছিলাম সেই নিউজ প্রথম পেইজে আজাদীতে ‘প্যানোস ফেলোশীপ নিয়ে ভারতে যাচ্ছেন ডেইজি মউদুদ’ শিরোনামে ছাপা হয় ছবিসহ। অবশ্য পূর্বকোণেও ছাপা হয়। খালেদ মামা, অরুণ দা, সাধনবাবু ( খালেদ মামা আর সাধনবাবু বাবার বন্ধু ছিলেন) উনাদের কথা খুব মনে পড়ে। সাংবাদিকতা করতে যেয়ে আরো বেশি যেন ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। তবে পাকিস্তানি হায়েনারা এই পত্রিকা অফিস সিলগালা করলে আমার মালেক মামার পরিবার আমাদের নানাবাড়ি ( মালেক মামাও ও নানার বাড়ি ( হাসমত মঞ্জিল ) তে উঠেন।
কোহিনুর, সোনালী একেবারেই ছোট। ওয়াহিদের জন্ম হবে কিছুকাল পরে। আমার বড়নানী (মালেক মামার মা ) ও ছিলেন।এই সময় মালেক মামার কিছু বন্ধু ও কিছুদিন এই বাড়িতে ছিলেন। মালেক মামার বন্ধু কোরেশী সাহেব, তার মেয়ে কান্তা আর কাকলি, এদের কথা মনে আছে। বাড়ির উঠোনে অনেক গাড়ির লাইন। চারিদিকে যুদ্ধ চলছে। জ্বালাও পোড়াও , এক কঠিন অবস্থা। সবাই রেডিও তে বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনছেন। রেডিওর আওয়াজ খুব ছোট করে দিয়ে । চতুর্দিকে এক দুঃসহ অবস্থা। ফকা চৌধুরীর নিউজ ছাপানোর কারণে মালেক মামাকে খুঁজছে ওরা। এরকম কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আমরা সবাই খুশিতে আটখানা। স্কুল বন্ধ, পড়াশোনার চাপ নেই। বাড়ি ভর্তি শহরের মেহমান। বড়ডেকে খানা পিনা পাক হচ্ছে।
কতগুলো মানুষের খাবার এর আয়োজন সে যেন এক বিশাল ব্যাপার। আমরা যুদ্ধ কি তা বুঝছিনা। সবাই ছোট, আমরা রাতদিন খেলাধূলায় মগ্ন। চাঁদনী রাতে ও খেলেছি কত রকমের খেলা। এরই মাঝে সেই বাড়িতে ওয়াহিদের জন্ম হলো। কি সুন্দর ফুটফুটে ছিল। কয়দিন পর এই বাচ্চার নাম রাখানি অনুষ্ঠান (নাম থোয়ানি) । বেবি ওয়াহিদকে সুন্দর করে গোসল টোসল করিয়ে বড়কোটায় হুজুরের সামনে কোলে করে আনা হলো।
আমরা সব বাচ্চারা গোল করে বসেছি। হুজুর খাতা কলম নিয়ে সবার মনে যে সব নাম আসছে তা লিখলেন। ফাহমিদা মালেক আর সানজিদা মালেক এর সাথে মিলিয়ে আমরা কত রকমের নাম দিয়েছি। যতদূর মনে পড়ে, ভেতরের রুম থেকে মামী নাম দিলেন ওয়াহিদ মালেক। সে নামটিই রাখা হলো। বেশ কিছুকাল আগে সেই বাড়িতে একটি মিলনমেলা হয়েছিল। সবাই গিয়েছিলাম। ওয়াহিদ আর পারিহাও গিয়েছিল। পারিহা বহু শখ করে ওয়াহিদের জন্মক্ষণের কক্ষটি দেখতে গেল। ছবিও তুলেছিল রুমটির। শুরুতেই বলেছিনা, আজাদীর সাথে স্মৃতিচারণ লিখে শেষ করতে পারবোনা। এখনো যখনই কোন বিষয়ে লেখা পাঠালে তা আমার প্রত্যাশার সীমানা ছাড়িয়ে ছাপা হয় গুরুত্বপূর্ণ পাতায় । প্রথম আর শেষ পাতায় সম্পাদক মহোদয় এবং বিশেষ বরেণ্য ব্যক্তি ছাড়া আর কারো লেখা ছাপা হয় কিনা আমার জানা নেই। এই তো সেদিন নারী ফুটবলারদের সংবর্ধনা দিল আজাদীর পক্ষ থেকে। সেদিন অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেদিনের অনুষ্ঠানটিতে ছিল অন্যরকম এক ভালো লাগা। মনের মাধুরী মিশিয়ে সেটি লিখে পাঠালাম। আমি পরের দিন পত্রিকার ভেতরের পাতায় খুঁজছি লেখাটি।
দেখলাম নেই। বুঝলাম দেরিতে পাঠিয়েছি, হয়তো স্পেস ছিলনা। ওমা দেখি, সেই ছোট্ট লেখাটি বাই নেইমে বক্স করে বাইরের পাতায় ছাপিয়ে দিয়েছেন। সে তো আমার জন্য এক মহাপ্রাপ্তি। আর অল্পদিন আগে ফেসবুকে ‘চাটগাঁইয়া রসম’ নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেটাও প্রথম পাতায় বক্স করে ছেপে দিয়ে আমায় অভাবিত প্রাপ্তিতে পূর্ণ করেছেন। একটা আঞ্চলিক পত্রিকা তার স্বকীয়তা নিয়ে এতো কাল পাঠকের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের পাঠক কি চায়, সেটিই তারা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ পত্রিকার যে একটা বৈশিষ্ট্য এবং স্বকীয়তা আছে, সেটা ভুলে যান নি। চাটগাঁইয়া ভাষায় অনেক নজর কাড়া হেডিং এ আমরা তাদের এই স্বকীয়তা প্রত্যক্ষ করি। আসলে এই পত্রিকায় আমার স্মৃতি এবং ঋণের শেষ নেই। এতো এতো স্মৃতি জড়িত এই পত্রিকা এবং এই পত্রিকার পরিবারের সাথে, যার শুরু আছে, শেষ নেই । প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভ কামনা দৈনিক আাজাদীর জন্য । অশেষ ভালোবাসা এই পরিবারের জন্য।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক