এতদিন চট্টগ্রামবাসীর দৃষ্টি ছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে। শেষ পর্যন্ত সারাদেশের মানুষের কাছেও এ নির্বাচন আগ্রহের সৃষ্টি করে।
নানা ঘটনা-অঘটনের মধ্য দিয়ে ২৭ জানুয়ারি বহুল প্রতীক্ষিত সে-ই নির্বাচন অবশেষে গত হয়েছে। আগ্রহ থাকলেও নির্বাচনের ঢামাডোলে এই কয়দিন করোনার টিকা সংক্রান্ত খবর ততটা নজর কাড়তে পারেনি। তবে চসিক নির্বাচন শেষ হওয়ায় চট্টগ্রামবাসীর পুরো দৃষ্টি এখন এই করোনার টিকায়। এরইমধ্যে চট্টগ্রামে টিকা আসার খবরে এই টিকা নিয়ে মানুষের আগ্রহ আরো বেড়েছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন- প্রথম দিকে টিকা নিয়ে মানুষের মাঝে এক ধরণের সংশয় ও ভীতি কাজ করেছে। কিন্তু ঢাকায় টিকাগ্রহণকারী কারো শরীরে তেমন কোনো জটিলতা দেখা না দেয়ায় এই সংশয় ও ভীতি কাটতে শুরু করেছে। আগে অনেকেই টিকা গ্রহণে অনাগ্রহের কথা জানালেও পরে মত পাল্টিয়ে টিকা গ্রহণে আগ্রহের কথা বলছেন। করোনার টিকা গ্রহণে আতংকের কিছু নেই জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী ও চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলছেন- বাংলাদেশ আনা অক্সফোর্ড-এস্ট্রেজেনেকার টিকা এরই মধ্যে নিরাপদ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বেশকয়টি দেশে এই টিকার সফল প্রয়োগ চলছে। এই টিকা গ্রহণের পর তেমন বড় ধরনের জটিলতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তাই বাংলাদেশে আনা এই টিকা নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করা যাবে। সুযোগ হলেই করোনার টিকা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন এই দুই কর্মকর্তা। চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দকৃত টিকা আগামীকাল (রোববার) সকালেই চট্টগ্রামে পৌঁছে যাবে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
প্রসঙ্গত, বুধবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর দেশে এরইমধ্যে করোনার টিকাদান (ভ্যাকসিন) শুরু হয়েছে। শুরুতেই রাজধানী ঢাকায় এ টিকাদান কার্যক্রম চলছে। আর ঢাকার বাইরে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে টিকাদান শুরুর ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক। সব ঠিক থাকলে মন্ত্রীর ঘোষিত সময়ে চট্টগ্রামেও করোনার টিকাদান শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
এদিকে, কয়েকদিন আগেই জেলা ভিত্তিক করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) বরাদ্দ দিয়ে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কার্টন হিসেবে বরাদ্দ দেয়া তালিকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে- প্রতি কার্টনে ১২০০ ভায়াল ভ্যাকসিন রয়েছে। সংশ্ল্লিষ্টরা জানিয়েছেন ভ্যাকসিনের প্রতি ভায়ালে ১০টি ডোজ রয়েছে। সে হিসেবে প্রতি কার্টনে ১২ হাজার ডোজ (১২০০ ভায়াল) ভ্যাকসিন থাকছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় দেখা যায়- চট্টগ্রামের জন্য ৩৮ কার্টন ভ্যাকসিন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে অতিরিক্ত আরো ৪ কার্টনসহ মোট বরাদ্দ উল্লেখ করা হয়েছে ৪২ কার্টন। ৪২ কার্টনে ৫০ হাজার ৪০০ ভায়াল হিসেবে মোট ৫ লাখ ৪ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন পাচ্ছে চট্টগ্রাম। যদিও প্রথম দফায় বরাদ্দের ৩৮ কার্টন ভ্যাকসিনই পাঠানো হচ্ছে বলে সংশ্ল্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলার অগ্রাধিকার তালিকাভুক্তদের মাঝে এই টিকা প্রদান করা হবে। আগামীকাল (রোববার) সকালে বরাদ্দকৃত টিকা চট্টগ্রামে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। তিনি বলেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত টিকা রোববার সকালেই তারা চট্টগ্রামে পৌঁছে দেবেন বলে জানিয়েছেন। এসব টিকা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ইপিআই স্টোরে রাখা হবে বলেও জানান সিভিল সার্জন।
ভ্যাকসিন গ্রহণে ৭ সদস্যের কমিটি : ঢাকা থেকে ভ্যাকসিন আসলে তা গ্রহণের জন্য ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে চট্টগ্রামে। সিভিল সার্জন এ কমিটির সভাপতি। অন্যান্যের মধ্যে জেলাপ্রশাসক ও পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, ইপিআই তত্ত্বাবধায়ক, ইপিআই কোল্ড চেইনের টেকনিশিয়ান, ওষুধ প্রশাসন এবং সিভিল সার্জন অফিসের একজন মেডিকেল অফিসারসহ মোট ৬ জনকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি এ কমিটি গঠনের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ সংক্রান্ত কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে রোববার ভ্যাকসিন বুঝে নেয়া হবে বলেও জানান সিভিল সার্জন।
ভ্যাকসিন পরবর্তী জটিলতা পর্যবেক্ষণে
১৪ সদেস্যর বিভাগীয় কমিটি : ভ্যাকসিন পরবর্তী জটিলতা পর্যবেক্ষণে ১৪ সদেস্যর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে চট্টগ্রামে। বিভাগীয় পর্যায়ে পোস্ট ভ্যাকসিন ইনফেকশন কন্ট্রোল নামে এ কমিটির চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক। কো-চেয়ারম্যান হিসেবে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক এবং সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন সিভিল সার্জন। এ সংক্রান্ত কমিটি গঠনের তথ্য নিশ্চিত করেছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর ও সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। কোভিড ভ্যাকসিন গ্রহণের পর গ্রহণকারীর শরীরে কোন ধরণের জটিলতা (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) দেখা যাচ্ছে কী না, তা পর্যবেক্ষণ করবে এ কমিটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শক্রমে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে সংশ্ল্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আয়োজনে ইতোমধ্যে দুই দিনের একটি ওয়ার্কশপেও অংশ নিয়েছেন এ কমিটির সদস্যরা।
নগরে টিকাদানে প্রস্তুতি : টিকাদানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এলাকার সার্বিক প্রস্তুতিও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এরইমধ্যে প্রাথমিকভাবে টিকাদান কেন্দ্র চূড়ান্ত করেছে চসিক করোনা ভ্যাকসিন প্রদান কমিটি। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- নগরের ১৫টি কেন্দ্রে করোনার টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। আর এসব কেন্দ্রে টিকাদানে নিয়োজিত থাকবে ৪২টি টিম। টিকাদানকারী হিসেবে ২ জন মিড ওয়াইফ, স্টাফ নার্স বা সিনিয়র স্টাফ নার্স এবং ৪ জন স্বেচ্ছা সেবকের সমন্বয়ে প্রতিটি টিমে মোট ৬ জন সদস্য থাকবেন। এরইমধ্যে কেন্দ্র ভিত্তিক টিম প্রস্তুত ও তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রস্তুতিও শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। আজাদীকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন চসিক করোনা ভ্যাকসিন প্রদান কমিটির সদস্য সচিব ও চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী।
টিকাদানে ১৫ কেন্দ্র : চট্টগ্রাম মহানগরে করোনার টিকাদানে নির্ধারণ করা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ২. চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ৩. চট্টগ্রাম সেনানিবাস হাসপাতাল ৪. চট্টগ্রাম পুলিশ হাসপাতাল ৫. সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতাল ৬. চট্টগ্রাম নৌ-বাহিনী হাসপাতাল ৭. চট্টগ্রাম বিমান বাহিনী হাসপাতাল ৮. চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতাল ৯. চসিক বন্দরটিলা হাসপাতাল ১০. চসিক মোস্তফা হাকিম মাতৃসদন হাসপাতাল ১১. চসিক ছাপা মোতালেব মাতৃসদন হাসপাতাল ১২. ইউএসটিসি হাসপাতাল ১৩. সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ১৪. মা ও শিশু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ১৫. মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। মহানগরের এই ১৫টি কেন্দ্রে করোনার টিকাদান কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে জানিয়েছেন কমিটির সদস্য সচিব ও চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী। তবে কেন্দ্র তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, রোববারের মধ্যে টিকা আসলেও লিখিত কোনো নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ে এই টিকাদান কর্মসূচি শুরুর সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন- মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা পেলে তবেই এ টিকাদান কর্মসূচি শুরু করা হবে। মন্ত্রণালয় ঘোষিত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তারা।
করতে হবে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন : ভ্যাকসিন পেতে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্তদের অনলাইনে বাধ্যতামূলক ভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এজন্য ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। ভ্যাকসিন পেতে তালিকাভুক্তরা সুরক্ষা প্ল্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (www.surokkha.gov.bd) গিয়ে অথবা মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে নিবন্ধন করতে পারবেন। অ্যাপটি ফ্রি ডাউনলোড করা যাবে। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও মোবাইল নম্বর দিয়ে এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় কেন্দ্র পছন্দের সুযোগ থাকবে। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে সংশ্ল্লিষ্ট ব্যক্তি (রেজিস্ট্রেশনকারী) ভ্যাকসিন গ্রহণের তারিখ ও কেন্দ্র সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যাবেন। নির্দিষ্ট তারিখে নির্ধারিত কেন্দ্রে গিয়ে সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রেশনকারী ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিতে পারবেন।