বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি সে প্রতিবাদে তেমন জোর আছে? দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কি ভাস্কর্য রাখার পক্ষে? এতদিন মূর্তি ভেঙে ভেঙে হাত পাকিয়েছে, বেড়েছে সাহস, আজ তাই তারা ভাস্কর্যে হাত বাড়িয়েছে। জাতীয় সমপ্রচার মাধ্যমগুলোতে বারবার প্রদর্শিত হচ্ছে পৃথিবীর বড় বড় ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে ছড়িয়ে থাকা সব ভাস্কর্য। বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে ভাস্কর্য একটা শিল্প। কিন্তু যতই চিৎকার করে বোঝানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, ‘মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়’, এরা তা শুনবে না। কারণ এরা সব জানে, সব বুঝে শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এদের অশুভশক্তি প্রদর্শনের জন্য। সাহসিকতা প্রদর্শিত করে তাদের অবস্থান ঝালিয়ে নেবার জন্য। জনপ্রিয় এক টিভি চ্যানেলে এক আলোচনায় একজন বক্তা বলছিলেন, ‘মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়, কথাটা বলে কি বোঝানো হচ্ছে? মূর্তি ভাঙা যাবে?’ তখন আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল, ছোটবেলা থেকে মা শিখিয়েছে মূর্তি বলবে না, প্রতিমা বলবে। পুজো করা হয় প্রতিমাকে। সেই থেকে লক্ষ্মী প্রতিমা, দুর্গা প্রতিমা’ই বলি এবং লিখি। ভুলেও মুখ দিয়ে কখনোও লক্ষ্মী মূর্তি বা দুর্গা মূর্তি বের হয় না।
যাই হোক মূল বিষয়ে ফিরে আসি ।
বঙ্গবন্ধুর ভাঙা ভাস্কর্যের ছবিটা টিভির পর্দায় দেখতেই বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠেছিল, মনে হয়েছিল কে যেন আমার হাতটা মুচড়ে ভেঙে দিয়ে গেছে। তারই ব্যথায় মুষড়ে পড়েছি। আমার চোখের সামনে ভাসছিল বঙ্গবন্ধুর সেই হাতের এক আঙুলের শক্তি, যে ছবির দিকে তাকালে এখনও রক্তে এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। হাত উঁচিয়ে বজ্রকন্ঠে সেই এক আঙুলের ডাকেই জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে পুরো দেশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একাত্তরে শত্রুদের ওপর। আর দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ করে, অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রম, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদার্পণকালে, বিজয়ের মাসে জাতির পিতার প্রতি এ আমাদের উপহার!
আমি অবস্থানগত কারণে সব কথা বলতে সাহস পাই না, ভয় হয় পাছে কোন কথায় আবার ধর্ম অবমাননা হয়ে যায়! খুন, ধর্ষণের মত জঘণ্য অপরাধের বিচার পেতে সময় লাগলেও, ধর্ম অবমাননার বিচারে কোন বিলম্ব হয় না, একেবারে ডাইরেক্ট অ্যাকশন!
প্রতিনিয়ত আশেপাশের অসুস্থ মানসিকতার মানুষগুলোর বাক্যবাণে বুকে অপমানের শেল বিধলেও, কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে থাকতে থাকতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। দেশটা তো আমাদের, জাতির পিতা তো আমাদেরও, তাই মানসিকতার এই পরিবর্তনগুলো প্রচণ্ড আঘাত হানে, বোবা যন্ত্রণায় ছটফট করে মন –
৭১’ এ আমি ছোট থাকলেও এর পর থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের ছবিগুলো চোখের সামনে পরিষ্কার। আগে আমাদের সবচাইতে বড় পরিচয় ছিল আমরা বাঙালি। ধীরে ধীরে এই পরিচয়টা এখন গৌণ। স্বীকার করি ঈর্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে আমাদের জীবনযাপনে, আমরা এখন ভালো খাচ্ছি ভালো পড়ছি, ভালো ভালো পোশাকও পড়ছি , তবে লেখাপড়া করে সত্যিকারের শিক্ষিত হচ্ছি কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে যথেষ্ট! লোকসংখ্যা বেড়েছে, তবে নি:সন্দেহে ভালো মানুষের সংখ্যা কমেছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাপীদের সংখ্যা। আয়-রোজগার যেমন বেড়েছে, প্রাপ্তির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চাহিদা আর লোভ। চলাফেরা, থাকা-খাওয়া সবকিছুতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আঙুলের ছোঁয়ায় জানতে পারি সবকিছু। কিন্তু মানসিকতা? সত্যিই কি আধুনিকতা পরশ বুলাতে পেরেছে আমাদের মানসিকতায়! বাস্তবিকপক্ষে সংকীর্ণতা, অসুস্থ মানসিকতা ঘিরে ধরছে আমাদের সমাজকে!
যুদ্ধের পর এমনকি যুদ্ধের সময়ও পাকবাহিনীর দোসরেরা কাজ করেছে গোপনে। আর আজ স্বাধীন দেশে তারা নির্লজ্জতার সাথে বুক ফুলিয়ে চলে! স্বগর্বে মাইকে চিৎকার করে বাঙালির বাঙালিয়ানাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, ইতিহাস বিকৃত করছে, জাতির পিতাকে অস্বীকার করছে, মা-বোনেদের সম্মান ধুলোয় লুন্ঠিত করছে- আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। এ যেন এমন, ‘দেখি ই না ব্যাটা কি করে!’ এই দেখতে দেখতেই আজকের এই দিন আমাদের দেখতে হচ্ছে। এক দিনে হঠাৎ করে এমনটা হয়নি ।একদিন হয়তো দেখবো ফুল পূজোর কাজে ব্যবহৃত হয় বলে অন্য সবকিছুতে ফুল বর্জনের ঘোষণা ঘোষিত হচ্ছে মাইকে। দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে সব ফুল গাছ!
সংগীত চর্চা, নৃত্য চর্চা বন্ধ করার আহ্বান আসছে! একে একে সমস্ত সুকুমারবৃত্তি চর্চা বন্ধ করার ডাক আসছে, বাঙালি সংস্কৃতি পদদলিত হচ্ছে-অসম্ভব কোন কিছুই নয়! এমনি ভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এমন আরোও অনেক অঘটন অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য। স্বাধীন দেশে চাষ হচ্ছে এসব স্বাধীনতা বিরোধীদের! বীজবপণ করা হয়েছিল অন্ধকারে, কিন্তু পরে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগে বাম্পার ফলনও হচ্ছে বছর বছর, ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের রেকর্ড। চারপাশের অনাবাদি জমিগুলোর সাথে সাথে আবাদি জমিগুলোও আসছে এদের চাষের আওতায়। এদের শেকড় এখন অনেক গভীরে। তাই দিন দিন গলার জোর বাড়ছে। অনেক মুখোশধারী প্রকাশ্যে সমর্থন করতে না পারলেও, মনে মনে তারা একই পথের অনুসারী।
শুনেছি বিশাল এলাকা জুড়ে যখন কেউ ফল, ফুল বা সব্জির বাগান করতে যায়, প্রথমে ওই পুরো জায়গার ঘাস- আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হয় ভালো ফলনের জন্য। এক ধরনের বিষ পাওয়া যায় যা ঘাসের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে সহজেই সব পরিষ্কার করে নেয়া যায়- ভাবছি সমাজের এই আগাছা পরিষ্কার করার জন্য তো এমন কোন বিষ প্রয়োগ সম্ভব নয়, তাই আগাছা বাড়তে দেয়া যাবে না। সময়মত আগাছা পরিষ্কার না করলে পরে বিষ প্রয়োগ ছাড়া উপায় থাকবে না। আর আগাছা পরিষ্কার না করে বাগান করলে আগাছার কারণে ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হবেই হবে। যত সময় যাবে, এদের দৌরাত্ম্য ততই বাড়বে। তাই যে কোন উপায়ে এই অশুভ শক্তি প্রতিহত করতে হবে। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে আমরা বাঙালি, এই পরিচয়’ই যেন মাথা উঁচু করে রয় চিরকাল।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার