নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫ আগস্ট বাংলাদেশের আকাশে নতুন সূর্য উন্মোচিত হয়েছে। দেড় হাজার ছাত্র–জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা দীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসনের ফসল, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতির আখড়া গজেছিল এই বাংলার জমিনে। সেই দুর্নীতি উপড়ে ফেলা কঠিন দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। এখনো স্বৈরাচারের দোসররা বিভিন্ন সেক্টরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের আস্ফালন গভীর আতংক ও রহস্যের ইঙ্গিত বহন করছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের মাধ্যমে এই গরিব দেশটিকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে এই স্বৈরশাসক কিন্তু এর প্রেতাত্মারা এখনো বিভিন্ন দপ্তরে–সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি হোক ঘাপটি মেরে বসে আছে। এই স্বৈরাচারের দোসররা কখনো ফিরে আসে আনসার লীগ হয়ে, কখনো বা ফিরে আসে রিক্সা লীগ হয়ে, কখনো বা ফিরে আসে সচিবালয় লীগ হয়ে–এভাবে ৫ আগষ্টের পর এই ৫ মাসে অসংখ্য ঘটনা– দুর্ঘটনার অবতারণা ঘটিয়েছে স্বৈরাচারের দোসররা। সর্বশেষ যে ঘটনাটি সারা দেশের মানুষের চোখকে চড়কগাছ করিয়েছে– সেটি হল সচিবালয়ে আগুন। এই আগুনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে গিয়েছে–এটা স্যাবোটাজ নাকি অন্যকিছু এখনো বলার সময় আসেনি, তবে স্বৈরশাসকের কুকর্মের নথিপত্র পুড়ে দেওয়ার কি অব্যর্থ চেষ্টা? সবচেয়ে ভয়ানক যে খবরটি প্রতিদিনকার সংবাদপত্রে ভেসে আসছে সেটি হল জুলাই–আগস্ট বিপ্লবের বিপ্লবী বীরদের টার্গেট কিলিং কিংবা গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা চেষ্টা, সমন্বয়কদের হুমকি–ধমকি এবং মহিলা সমন্বয়কদের ধর্ষণের হুমকি–এগুলো কিসের ইঙ্গিত বহন করে? এসমস্ত ঘটনার মূলে চলে আসছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠনটির দিকে। প্রকৃত স্বৈরাচারের দোসররা যেন পাগলা কুকুরের মতন ঘেউ ঘেউ করছে। যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি জবাবদিহিমূলক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তাদের এই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে লুকিয়ে থাকা স্বৈরাচারের দোসররা যেন আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। আরেকটি ভয়াবহ চিত্র এই যে– ৫ মাসে আমরা দেখতে পেরেছি সেটি হল: এক স্বৈরাচার পতনের পর যেন আরেকটি স্বৈরাচারের সুস্পষ্ট উত্থান। এরই মধ্যে বহু ঘটনার সাক্ষী বাংলার দুঃখী মানুষেরা। বাংলাদেশের বড় একটি রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য গ্রুপিং, বিভাজন, রক্তপাত পরিবেশকে কলুষিত করে তুলেছে যেমন: রাউজানের গোলাম আকবর খন্দকার ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রকাশ্যে গ্রুপিং, ৩০ টির অধিক সংঘর্ষের ঘটনা–রাউজান যেন আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপির গ্রুপিংয়ের কারণে সংঘর্ষের ঘটনায় রক্তপাত হয়েছে, খুন হয়েছে। সেই স্বৈরাচারের আমলের মতই চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে অবলীলাক্রমে। এদেশের মানুষ মনে করেছিল–স্বৈরাচার পতনের পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে কিন্তু তাদের সেই আশা গুড়েবালি। বিএনপির প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব এখন টপ অব দা কান্ট্রি। রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চায় অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পূূর্ণ সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দিতে নারাজ। এ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে স্নায়ু যুদ্ধ। শুধুমাত্র কোটা আন্দোলনকে ঘিরে দেশব্যাপী যে সহিংসতা, দমন নিপীড়ন হয়েছে তা ইতিহাসে বিরল। দেশের শীর্ষ কর্তা ব্যক্তির অপমানজনক বক্তব্যের কারণে ফুঁসে উঠেছিল ছাত্রজনতা। ফলশ্রুতিতে প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থানে পালাতে বাধ্য হয়েছে দীর্ঘকাল জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসা স্বৈরশাসক। এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কেন যেন ঘন আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ তাই প্রমাণ করছে। একদিকে প্রশাসন ক্যাডারে অস্থিরতা, অন্যদিকে অন্যান্য ক্যাডারে পদোন্নতিতে বৈষম্য–এসব নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে। ১৬ বছরের জঞ্জাল ৫ মাসে কি সরানো সম্ভব? কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের তাগাদা দিচ্ছে বারবার। একপক্ষ ১৬ বছর না খেয়ে আছে, তারা খাই খাই করে যেন পাগলপারা। এরই মধ্যে দুর্নীতি, মারামারি, খুনোখুনি, হানাহানিতে লিপ্ত বিএনপির মতন বড় দল–তাদেরকে কে থামাবে? একটি স্বৈরাচার ১৬ বছর এদেশের মানুষকে অপশাসনের অবয়বে বিষিয়ে তুলেছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ–এহেন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যে গত ১৬ বছরে স্বৈরশাসকরা করেনি। কারো ভোটাধিকার ছিল না, কেউ ভোট দিতে যেতে পারেনি অথবা যাওয়ার আগেই তার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। বিচার বিভাগকে তারা করায়ত্ত করে দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংসের দ্বারপান্তে নিয়ে গেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয়নি, সংবিধানকে পর্যন্ত কাটাছেঁড়া করতে দ্বিধাবোধ করেনি। আর ওদিকে খুন, গুম, আয়নাঘর তো আছেই। কত মায়ের বুক খালি করেছে গত স্বৈরশাসক–তার কোন ইয়ত্তা নেই। লাখো মানুষের নোনাজারি আল্লাহর আরশকে যেন কাঁপিয়ে তুলেছিল। আমার তো মনে হয় যদি আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসে তাহলে ইপ্সিত কোন পরিবর্তন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি কারণ দু’টি বড় দলই দুর্নীতিতেই জরাগ্রস্ত– এটা তাদের অতীতের জ্বলন্ত উদাহরণ। এই দলটি অতীতে কয়েকবার দেশ শাসন করেছে। কিন্তু জনআকাঙ্ক্ষার কোন পরিবর্তন হয়নি। তাহলে বুঝা যায়–দীর্ঘ ৫৩টি বছর এই দুটি দলের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত ছিল বাংলার আবাল–বৃদ্ধ–বনিতা। যে লক্ষ্য নিয়ে হাজারো ছাত্র জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল ৫ই আগস্ট তার উত্তম মর্যাদা আমরা কি সেই শহীদদের দিতে পেরেছি? উত্তর: না। অতএব, এই জমিনে শাসন চলবে তাঁর–যিনি এই জমিনের মালিক। এই জমিনের কানুন চলবে তাঁর–যিনি এই বিশাল আকাশ–জমিনের মালিক। এই সাধারণ কথাটি ১৮ কোটি মানুষের মাথায় কেন যে আসে না তা বলাই বাহুল্য। দুর্নীতি, অপশাসন সমূলে উৎপাটিত হবে নিমিষেই। খুন, ধর্ষন, রাহাজানি, বিচার কোরানিক যদি হয়, তাহলেই সমস্ত অবিচার, জুলুম নিঃশেষ হয়ে যাবে ক্ষণিকের মধ্যেই। চুরি কিংবা যেনার শাস্তি যদি প্রকাশ্যে দেওয়া হয়, তাহলে আর কেউ এর পুনরাবৃত্তি করার দুঃসাহস দেখাবে না কস্মিনকালেও। অথচ খুনের আসামিরাও ছাড়া পেয়ে যায় মানব রচিত আইন প্রণয়নের কারণে। দুর্নীতি বারবার ফিরে আসে বাংলার আকাশে–বাতাসে। কোরআন দ্বারা যদি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তাহলে সব অবৈধ কর্মকাণ্ড, জুলুম, অবিচারের অবসান হবে–এতে বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহ নেই। এই দুনিয়াকেই বেশি ভালবেসেছি আমরা অথচ আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘এই লোকেরা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন খরিদ করে নিয়েছে, তাদের উপর থেকে আযাব কিঞ্চিৎ পরিমাণও হালকা করা হবে না, না সেদিন তাদের সাহায্য করা হবে’– সূরা–বাকারা–৮৬।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল