আখেরাতের প্রস্তুতি

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

পর্ব : ৬ ॥ আখেরাতের বিশালতা বুঝতে গেলে আল্লাহর কোরআন এবং রাসূল (সাঃ) হাদীসের অনেক গভীরে যেতে হবে। দিন চলে যাবে, মাস চলে যাবে, বছর চলে যাবেআখেরাতের আলোচনার কোন কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আখেরাত একটি সমৃদ্ধ এবং সময়োপযোগী আলোচনা। বান্দার সমস্ত কাজকর্মের মূল্যায়ন আখেরাতের জীবনে মহান রাব্বুল ইজ্জত অবশ্যই করবেন। আর এর উপর ভিত্তি করেই নির্দিষ্ট হবে জান্নাত এবং জাহান্নামের ঠিকানা। যারা জান্নাতের অধিবাসী হবে, তারাই সফলকাম আর যারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে তাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ হতে পারে না। আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কালামে স্পষ্ট করে বলছেন, ‘জাহান্নামের অধিবাসী ও জান্নাতের অধিবাসীরা এক হতে পারে না, জান্নাতবাসীরাই সত্যিকার সফলকাম’সূরা আল হাশর২০।

অন্য একটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অন্ধ ও চক্ষুষ্মান এবং যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে আর যারা দুষ্কৃতপরায়ণ। তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’সূরামু’মিন৫৮। সূরা সোয়াদ এর ২৮ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায় আমি কি তাদেরকে সমভাবে গণ্য করব? আমি কি মুত্তাকীদেরকে অপরাধীদের সমান গণ্য করব?’। অর্থাৎ এই সব আয়াত থেকে এটাই প্রমাণ করে যে, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সৎ আমলধারীদেরকে সম্মানিত করবেন এবং পাপীদেরকে লাঞ্চিত করবেন। এজন্য আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জান্নাতবাসীরাই সফলকাম অর্থাৎ মুসলিমরা আল্লাহতায়ালার আযাব থেকে পরিত্রাণ লাভকারী’। জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহতায়ালা যে সুসংবাদ দিয়েছেন তা আল কোরআনের প্রতিটি পাতায় পাতায় বিধৃৃত হয়েছে। যেমন: সূরা হামীম আস সাজদাতে তিনি বলেন, ‘যারা বলে আল্লাহতায়ালাই হচ্ছে আমাদের রব, অতপর (ঈমানের উপর) তারা অবিচল থাকে, (মৃত্যুর সময় যখন) তাদের কাছে ফেরেশতারা নাযিল হবে এবং তাদের বলবে, তোমরা ভয় পেও না, চিন্তিত হয়ো না; তোমাদের কাছে যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছিল তোমরা তারই সুসংবাদ গ্রহণ কর। আমরা (ফেরেশতারা) দুনিয়ার জীবনে তোমাদের বন্ধু ছিলাম আর আখেরাতেও, সেখানে তোমাদের মন যা কিছু চাইবে, তাই তোমাদের জন্য মজুদ থাকবে এবং যা কিছুই তোমরা সেখানে তলব করবে তা তোমাদের সামনে থাকবে। পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে (এ হচ্ছে তোমাদের সেদিনের) মেহমানদারী’৩০৩২। এই জান্নাত পাওয়ার জন্য আল্লাহর বান্দারা যে প্রতিযোগিতা করে থাকে তাকে উৎসাহ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলছেন,‘তোমরা তোমাদের মালিকের ক্ষমা পাওয়ার কাজে প্রতিযোগিতা কর, আর সেই জান্নাতের জন্যেও (প্রতিযোগিতা কর), যার প্রশস্তা আকাশসমূহ ও পৃথিবী সমান, এটি মুত্তাকীদের জন্যে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে’সূরা আলে ইমরান১৩৩।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি স্বচক্ষে কেয়ামতের দৃশ্য দেখার আনন্দ উপভোগ করতে চায়, তাহলে তার সূরা তাকভির, সূরা ইনফিতার, সূরা ইনশিক্বাক পড়া উচিৎ’। আখেরাতের প্রস্তুতি হিসাবে আমাদেরকে মিথ্যা সাক্ষ্য দান থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ব্যাপারে সূরা আল ফোরকানে মুমিনদের গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি আয়াত রয়েছে, ‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না’। সূরা আল হজ্বে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করছেন, ‘তোমরা মিথ্যা থেকে আত্নসংবরণ কর’। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্যদান শিরকের সমান’আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, তাবারানি। ইবনে মাজাহে বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার জন্য জাহান্নামের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত সে পা নাড়াতেও পারবে না’। মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা ৪টি বড় বড় গুণাহে লিপ্ত হয়। প্রথমত সে মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা অপব্যয় ও মিথ্যাবাদীকে হেদায়াত করেন না’সূরা আল মু’মিন। দ্বিতীয়ত সে যার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তার উপর জুলুম করে। কেননা এ দ্বারা সে তার জানমাল অথবা সম্মানের ক্ষতিসাধন করে। তৃতীয়ত সে যার পক্ষে সাক্ষ্য দেয় তার উপরেও জুলুম করে। কেননা সে তার জন্য হারাম সম্পদ ভোগের ব্যবস্থা করে দেয়, ফলে তার জন্য জাহান্নাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘মিথ্যা সাক্ষীর প্রভাবে আমি যদি কাউকে অন্য কোন মুমিন ভাইয়ের সম্পদ দেওয়ার নির্দেশ দিই, তবে সে যেন তা গ্রহণ না করে। কেননা ঐ সম্পদ তার জন্য জাহান্নামের আগুনের একটি টুকরো’ সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম। চতুর্থত সেই মিথ্যা সাক্ষীর মাধ্যমে একটি নিষিদ্ধ সম্পদ, প্রাণ বা সম্মানের উপর অন্যের হস্তক্ষেপ বৈধ বানিয়ে দেয়। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জঘন্যতম কবিরা গুণাহ কি কি বলব না? তা হচ্ছে: আল্লাহর সাথে শরীক করা, মাতাপিতাকে কষ্ট দেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, সাবধান মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া সহীহ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি। বর্ণনাকারী বলেন, শেষের কথাটি তিনি এতবার পুনরাবৃত্তি করেন যে, আমরা মনে মনে বলছিলাম যে আহা উনি যদি এখন চুপ করতেন, তবে ভালো হত। আমাদের সমাজে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায় আইনপেশায়।

মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে এবং মিথ্যা সাক্ষী বানিয়ে অনেক নিরাপরাধ মানুষকে জালিমের কারাগারে যাবজ্জীবন বন্দী রাখা হয় অথবা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। হর হামেশা মহৎ আইনী পেশায় আল্লাহর বিধান চালু না থাকার কারণে এবং খোদাভীরু বিচারকের অভাবে পদে পদে আইন কলুষিত হচ্ছে । আইনকে বিবর্তন করে কিংবা ঘষামজা করে আইন পাল্টিয়ে, মিথ্যা প্রতারণামূলক রায় দেওয়া হচ্ছেযা পৃথিবীর জঘন্যতম মানবাধিকারের লঙ্ঘন। অতএব আসুন, এই মহৎ আইন পেশাকে মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বস্তুনিষ্ঠ আইনকে সঠিক এবং সমানভাবে প্রয়োগ করিযাতে করে মজলুম মানুষরা সঠিক বিচারটুকুন পায়এটিই হয়তো হতে পারে আপনার আখেরাতের প্রস্তুতির পূর্র্ব উপাদান। আমিন।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষায় প্রযুক্তির অবদান
পরবর্তী নিবন্ধজাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন: একজন অদম্য কর্মবীরের জীবনালেখ্য