পর্ব–৩
বিশুদ্ধ নেক আমল নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি আছে কি? যদি না থাকে এখন থেকেই সেই প্রস্তুতি থাকা জরুরি। কেননা কঠিন কেয়ামতের দিন বান্দার আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য একমাত্র হেদায়াতগ্রন্থ আল্–কোরআনকে নিজের জীবনের সাথে রাঙিয়ে তুলতে হবে। এই কোরআনের বিধান দ্বারা বিপর্যস্ত সমাজকে বদলাতে হবে। নিজের পরিবারকে আল্–কোরআনের বিধান অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে। সমাজকে নবরূপে সাজাতে হবে কোরআনের বিধান দ্বারা। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে কোরআনের প্রতিটি উপাদান দিয়ে গড়ে তোলার জন্য একজন বিশ্বস্ত নেক আমলধারী ব্যক্তির ফিকির থাকা অত্যন্ত জরুরী। কারণ এই কোরআনই আসমানের নিচে এবং জমিনের উপর একমাত্র সত্য কিতাব যার কোন বিকৃতি হবে না আগামী কেয়ামত পর্যন্ত। এই কোরআনের পক্ষে কাজ করলে কোরআন মানবজাতিকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করবে এবং এই কোরআনের বিপক্ষে যদি কেউ কাজ করে তাহলে কোরআন তাকে জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করবে। কারণ, এটি সত্য–মিথ্যার পার্থক্যকারী এবং হেদায়াতের অকাট্য দলিল। যেহেতু আল্লাহতায়ালা মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় এই কোরআনকে সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন অতএব কাল কেয়ামতের মাঠে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা আয যোখরুফের ৪৪ নং আয়াতে বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে এই (কুরআন) হচ্ছে তোমার ও তোমার জাতির জন্য উপদেশ, অচিরেই তোমাদের (এ ব্যাপারে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’। অতএব এই কুরআনকে যদি কেউ উপেক্ষা করে অথবা এর হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে কাল কেয়ামতের কঠিন ময়দানে তাকে দূর্ভোগ পোহাতে হবে। কারণ মানুষের হায়াত সীমিত। বান্দার ইহকালীন সমস্ত পাথেয় যদি নেক আমলের উপযোগী হয় তাহলে আল্লাহর কাছে এটা গৃহিত হবে এবং সেটা তার আমলনামায় সবিস্তারে লিপিবদ্ধ থাকবে। আল্লাহতায়ালা আমাকে/আপনাকে যে হায়াতটুকু দান করেছেন তার যথাযথ প্রয়োগ যদি করা না হয় তাহলে পরকালীন জীবনে দূর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। আর আল্লাহতায়ালার হেদায়াতপ্রাপ্ত না হয়ে যেন আমাদের কারও মৃত্যু না হয়–সেই দোয়াটুকু প্রতিনিয়ত আমাদের দোয়ার আসরে থাকা উচিৎ, ‘অতএব যে আমার হেদায়াত অনুসরণ করবে সে না কখনো (দুনিয়ায়) বিপথগামী হবে, না (আখেরাতে সে) কোন কষ্ট পাবে’–সূরা– ত্বাহা– ১২৩। হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আমার রাসূল (সাঃ) এর প্রিয় চাচা আবু তালেব এর জীবদ্দশায় রাসূল (সাঃ) এর পেছনে পেছনে ছায়ার মতো ছিলেন, ভ্রাতুষ্পুত্রের যেন কোন ক্ষতি না হয় তার জন্য সদা সর্বদা সজাগ থাকতেন তিনি কিন্তু মৃত্যুর সময় মুশরিক হিসাবেই তাঁর মৃত্যুবরণ হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁর মুখ দিয়ে কালেমা পড়াতে পারলেন না। অতএব এতেই বুঝা যায়, মহান আল্লাহতায়ালা যদি কাউকে হেদায়াত না করেন তাহলে তার কপালে আছে বিষাদময় দুঃখ আর বেদনার কষ্টি পাথরে মিশ্রিত জীবন আর তার আখেরাত হবে অত্যন্ত বেদনাবিধূর। ‘তিনি তোমাদের জীবন দান করেছেন, অতঃপর তিনি তোমাদের মৃত্যু দিবেন, পুনরায় তিনি তোমাদের জীবন দান করবেন, অবশ্যই মানুষ অতিমাত্রায় অকৃতজ্ঞ’– সূরা–আল হাজ্ব– ৬৬। মৃত্যুর কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। এই মৃত্যুই অবধারিত সত্য–এটাকে মেনে নিয়েই আমাদের জীবন গড়তে হবে। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি ক্ষণের জবাব আল্লাহতায়ালার দরবারে দিতেই হবে–এতে কোন সন্দেহ নেই। ‘যে ব্যক্তি এক অণু পরিমাণ কোন ভাল কাজ করবে (সেদিন) তাও সে দেখতে পাবে; (ঠিক তেমনি) কোন মানুষ যদি অণু পারিমাণ খারাপ কাজ করে, তাও (সেদিন) সে দেখতে পাবে’ – সূরা– আয্ যেলযাল–৭ ও ৮। হযরত লোকমান তাঁর প্রিয় বৎসকে দেওয়া নসিহত আল্লাহতায়ালা তাঁর কিতাবে কোড করেছেন এভাবেই, ‘হে বৎস, যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণ হয় এবং তা যদি কোন শিলাখন্ডের ভেতর কিংবা আসমানসমূহে (লুকিয়ে) থাকে, অথবা (যদি তা থাকে) জমিনের ভেতরে,তাও আল্লাহতায়ালা (সেদিন সামনে) এনে হাজির করবেন; অবশ্যই আল্লাহতায়ালা সূক্ষ্মদর্শী, সকল বিষয়ে সম্যক অবগত’ – সূরা– লোকমান ১৬। অতএব বোঝা যায়, নেক আমলকারীরা আল্লাহতায়ালার পরম বন্ধু–যারা আল্লাহতায়ালার বন্ধু হিসাবে স্বীকৃতি পায় তাদের কোন ভয় নেই, চিন্তা নেই–এই ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা তাঁর কালামে পাকে অসংখ্যবার ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহতায়ালার বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না’– সূরা – ইউনুস–৩২। পরকালীন পাথেয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে মুমিন জীবনে তাকওয়ার ভূমিকা অপরিসীম। তাকওয়াবান ব্যক্তি সমস্ত গুণাহ থেকে বেঁচে থেকে নেক আমল সম্পাদনে ব্যস্ত থাকেন, যাতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নেক আমলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ‘তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় করতে থাক; তোমরা যা কিছু করছো, অবশ্যই আল্লাহতায়ালা তা জানেন’ সূরা–হাশর–১৮। জাগতিক জীবনে নেক আমলের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হল সদকায়ে জারিয়া–এটি একজন মুসলমানের জান্নাতে যাওয়ার পথকে অত্যধিক সুগম করে দেয়। পরকাল জীবনে পাথেয় হিসাবে এই আমলটির গুরুত্ব অধিক কারণ সদকায়ে জারিয়ার সুফল মানুষের মৃত্যুর পরও চলতে থাকবে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন, একজন মুমিন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁর আমলনামায় যে নেকি যোগ হবে তা হল–যদি সে শিক্ষা অর্জনের পর তা অপরকে শিক্ষা দেয় ও প্রচার করে, নেক সন্তান রেখে যায় অথবা ভাল বই রেখে যায় অথবা মসজিদ নির্মাণ করে দেয় অথবা মুসাফিরের জন্য সরাইখানা নির্মাণ করে অথবা নদী খনন করে দেয় অথবা জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য সম্পদ থেকে সদকা করে’ (সুনানে ইবনে মাজাহ , হাদীস নং– ২৪২)। অতএব, তাওহীদ ও শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান, বিশুদ্ধ নেক আমল, সর্বাবস্থায় তাকওয়া, সদকায়ে জারিয়া, সুন্নাতের পাবন্দি একজন মানুষের জাগতিক জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। দুনিয়ার জীবনে যারা বদ আমল করতে করতে জীবনটাকে নিঃশেষ করে দেয় তারা কোনদিন হেদায়েতের গন্ধও পাবে না। কারণ, ‘(এরা) বধির, বোবা, অন্ধ, অতঃপর এরা (আজ সঠিক পথের দিকে) ফিরে আসবে না’– সূরা আল বাকারা– ১৮। যারাই আল্লাহর প্রদত্ত জীবন বিধান বিবর্জিত সমাজকে বেছে নেয়, সেই সমাজে নিজের জীবনটাকে গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দেয় এবং তওবা না করে মৃত্যুবরণ করে, তাদের আখেরাতের জীবন হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আখেরাতের কঠিন ময়দানে কেউ কারো কাজে আসবে না। এই ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, ‘সে দিন মানুষ তার নিজ ভাইয়ের কাছ থেকে পালাতে থাকবে, (পালাতে থাকবে) তার নিজের মায়ের কাছ থেকে, নিজের বাপের কাছ থেকে, তার সহধর্মিনী থেকে, (এমনকি) তার ছেলে–মেয়েদের থেকেও’–সূরা–আবাসা–৩৪,৩৫ ও ৩৬। সর্বদা মৃত্যুর প্রস্তুতি থাকতে হবে একজন সচেতন মুসলিমকে। কারণ যে কোন সময় মৃত্যুর সাইরেন বাজতে পারে, ‘তুমি বল, অবশ্যই সেই মৃত্যু যার কাছ থেকে তোমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছো, (একদিন) তোমাদের তার সামনাসামনি হতেই হবে, তারপর তোমাদের সেই মহান সত্তা আল্লাহর দরবারে হাজির করা হবে, যিনি মানুষের দেখা অদেখা যাবতীয় কিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, অতপর তিনি সেদিন তোমাদের সবাইকে বলে দিবেন তোমরা দুনিয়ার জীবনে কে কি করছিলে!’ সূরা– আল জুমুয়াহ– ৮।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল