পর্ব–১ : আখেরাত–সীমাহীন এক ঠিকানা, যার শুরু আছে–শেষ নেই। প্রত্যেক মানব সন্তানের জীবনে আখেরাত আসবেই এবং তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুরু হবে আখেরাতের অনন্ত জীবন এবং সেই আখেরাত কারো জন্য হবে ভয়ানক কঠিন আবার কারো জন্য হবে অত্যন্ত সহজ। এই বিশ্বের প্রত্যেকটি মানুষতে মৃত্যুর মুখোমুখি হতেই হবে। এই অমোঘ নিয়ম থেকে কেউ রেহাই পাবে না, ‘মৃত্যু যন্ত্রণার মুহূর্তটি (যখন) এসে হাজির হবে (তখন তাকে বলা হবে) এই হচ্ছে সে (মুহূর্ত)টা, যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে!’-সূরা ক্বাফ–১৯। এই পরকালীন যাত্রায় সবাই আখেরাতের মুসাফির। এই বর্ণাঢ্য পৃথিবীর রঙিন জীবনের সকল মায়া–মমতা ত্যাগ করে চলে যেতে হবে সেই চির অচেনা না ফেরার দেশে, যেখান থেকে কেউ এই নশ্বর পৃথিবীতে আর কোনদিন ফিরবে না, চিরদিনের জন্য তাকে চলে যেতে হবে দূর বহুদূর। নিজ মমতাময়ী স্ত্রী, পুত্র–সন্তান আত্নীয়–স্বজন, বন্ধু–বান্ধব, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী সবাইকে ছেড়ে অনন্ত গন্তব্যে পাড়ি দিতে হবে আমাদের সবাইকে। সুজলা–সুফলা–শস্য–শ্যামলা এই পৃথিবীর জমিনে একাকী আসতে হয়। আবার পরকালীন যাত্রাও অসম্ভব একাকী–সাথে কেউ যাওয়ার সুযোগ নেই। যে স্ত্রী কিংবা সন্তান–সন্ততিকে জিন্দেগীভর বুক ভরে ভালবেসেছেন, জীবনের সমস্ত শ্রম তাদের পেছনে ত্যাগ করেছেন, অর্জিত অর্থের অধিকাংশ তাদের সুখ–স্বাচ্ছ্যন্দের জন্য ব্যয় করেছেন–সেই অতি আপনজনরাই আপনাকে অশ্রু সজল নয়নে বিদায় দিতে বাধ্য হবে। দামী মর্মর পাথরে গড়া আপনার বিলাসবহুল ভবনে আপনার মরদেহ রাখা হবে না। আর কোনদিন দামী পাথরে গড়া ভবনে আপনার থাকার সুযোগ হবে না। বিদেশী টাইল্সে নির্মিত দামী গোসলখানায় আর কোনদিন আপনার গোসল করা হবে না। অন্তিম গোসল ও কাফন পরানোর পর আপনার মরদেহটি সেই বর্ণাঢ্য ও সুসজ্জিত বালাখানার এক পাশেই রেখে দেওয়া হবে। মাইকিং করে আপনার জানাযার খবর দেওয়া হবে এলাকাবাসীকে। আপনার অতি আপনজনেরাই আপনার দাফন তাড়াতাড়ি করার জন্যে তাগিদ দিতে থাকবে। কেননা দেরী হলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আপনার মরদেহের পচন শুরু হবে। আপনি দাপুটে কাটিয়েছেন জিন্দেগীভর কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন কিংবা প্রভাবশালী মন্ত্রী–সাংসদ ছিলেন কিংবা বদমেজাজী ও অহংকারী প্রশাসনিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন কিংবা বিভিন্ন পেশাজীবি দাপুটে কর্মচারী ছিলেন–আর এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আপনার যবনিকাপাত হবে অহংকারের সুরম্য পাঠশালা। এই পৃথিবীতে নাস্তিক আছে–যারা আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এই মৃত্যুর উপর কোন নাস্তিক নেই–এটাই অবধারিত সত্য। এই মৃত্যুকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে এযাবৎকাল পারেনি–আগামী কেয়ামত অবধি পারবে না। এমনকি পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির মৃত্যুর পর মা’লাকুল মাওতকেও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, ‘প্রত্যেক জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’– সূরা আল ইমরান– ১৮৫। এই পৃথিবীতে একমাত্র থাকবে এবং থাকবেই মহা পরাক্রমশালী, সুপার পাওয়ার, সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা–তিনি চিরঞ্জীব আর কেউ চিরঞ্জীব হতে পারে না, পারবেও না। এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর অন্তিম ঠিকানা আখেরাতের প্রস্তুতি হিসাবে কি পাথেয় আপনাকে নিতে হবে তা কি আপনার পরিশুদ্ধ জ্ঞানের পরিমন্ডলে কিলবিল করছে না? ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় কর, প্রত্যেকটি মানুষের লক্ষ্য করা উচিৎ আগামীকাল (আল্লাহর সামনে পেশ করার) জন্যে সে কি (আমলনামা) পেশ করতে যাচ্ছে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করতে থাক; তোমরা যা কিছু করছো, অবশ্যই আল্লাহতায়ালা তা জানেন’– সূরা আল হাশর–১৮। এই পরকালীন অন্তিম যাত্রার প্রথম আবাস হবে কবর, এরপর হাশর, এরপরেই জান্নাত নয়তো জাহান্নাম। এই বিশাল পথ পরিক্রমায় সকলকেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। নিজস্ব আমলের যাচাই–বাছাই হবে, জিন্দেগীর সার্বিক কর্মকান্ডের জন্যে জবাবদিহিতা করতেই হবে। আর এসমস্ত পথপরিক্রমায় যে ব্যক্তি কামিয়াব হতে পারবে তার মুক্তি নিশ্চিত–অন্যথায় তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। এই অন্তিম সফরের আগে সমস্ত মানব সন্তানকে সেই কঠিন কেয়ামতের দিন বিচারের সম্মুখীন হওয়ার আগে নিজের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। মহান আল্লাহর প্রদত্ত জীবনবিধান আল্–কোরআনের পথে যারাই যাত্রী হয়েছেন তাদের মুক্তির অপার সম্ভাবনা থাকে। আর এর বিপরীতে যদি আল্লাহর কোরআন এবং রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ বিরোধী কর্মকান্ডের যাত্রী হয়ে থাকে তাহলে তিনি পড়বেন পরকালের মহাসংকটে। তিনি কাঙ্খিত গন্তব্যে কোনদিন পৌঁছতে পারবে না। বিপদ হবে তার নিত্যদিনের সাথী। আমাদের সবার জীবনকাল সু–নির্ধারিত, ‘তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তিনি (সবার বাঁচার একটি) মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, (তেমনি তাদের মৃত্যুরও) তার কাছে একটা সুনির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে, তারপরও তোমরা সন্দেহ করছো’! সূরা আল আনআম–০২। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘কোন প্রাণী আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরবে না, (আল্লাহতায়ালার কাছে সবার) দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট, যে ব্যক্তি পার্থিব পুরস্কারের প্রত্যাশা করে আমি তাকে (এ দুনিয়াতে) তার কিছু অংশ দান করি, আর যে ব্যক্তি আখেরাতের পুরস্কারের ইচ্ছা পোষণ করবে, আমি তাকে সে (পাওনা) থেকেই এর প্রতিফল দান করব এবং অচিরেই আমি কৃতজ্ঞদের প্রতিফল দান করব’– সূরা আল ইমরান– ১৪৫। জিন্দেগীর জীবনটা হচ্ছে আখেরাতের সন্ধ্যাবেলা আর মৃত্যু হচ্ছে আখেরাতের সকালবেলা অর্থাৎ মৃত্যু দিয়েই তার সীমাহীন হায়াত শুরু হয়, যা আর কোনদিন শেষ হবার নয়। বিখ্যাত ইসলামিক লেখক, স্কলার, সাড়া জাগানো তাফসির গ্রন্থ ‘ফি যিলালিল কোরআন’ এর প্রণেতা সাইয়্যেদ কুতুব শহীদকে যখন ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। ভয়ংকর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল জেলখানার বদ্ধ রুমে। সেই পাগলা কুকুর খাবলে ছিঁড়ে ফেলেছিল তাঁর শরীরের মাংস। দু’জন পুলিশের কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন–হঠাৎ তাঁর চোখেমুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেল।
সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলেন এই সময় আপনি হাসছেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন–আমি তো মৃত্যুর দিকে নয়, হায়াতের মহা–সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছি–সুবহানাল্লাহ ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের তোমরা কোন অবস্থাতেই মৃত মনে কর না, তারা তো জীবিত, তাদের মালিকের কাছে তাদের রেযেক দেওয়া হচ্ছে’–সূরা আল ইমরান– ১৬৯। তিনি তো শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন। প্রত্যেক মৃত্যুই কষ্টকর। কিন্তু শাহাদাতের মৃত্যু অত কষ্টকর নয়, কারণ আল্লাহতায়ালা শাহাদাতবরণরত শহীদকে জান্নাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখাতে দেখাতে তাঁর কাছে নিয়ে যান। সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখতে থাকেন শাহাদাতবরণরত যাত্রী আর এই মৃত্যুতে তাঁর কোন কষ্টই লাগে না। বাতিল শক্তি তাঁর বুকে ছুরিকাঘাত করছে, হাত কিংবা পা কর্তন করছে কিংবা বুকে বুলেটবিদ্ধ–এটা তার কোন কষ্টই লাগে না, কারণ সে সময় মহান রব তাঁকে জান্নাতের মনোরম দৃশ্যগুলো দেখাতে থাকেন। এই মৃত্যু সবার কামনা করা দরকার, শাহাদাতের তামান্না নিয়েই সবার পরপারে যাওয়া উচিৎ। শাহাদাতের মৃত্যু না হলেও সেই মর্যাদা তো আল্লাহতায়ালা দিবেন–ইনশাআল্লাহ। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনি তোমাদের পুনরুত্থিত করবেন। তারপরও মানুষ অতি অকৃতজ্ঞ’ সূরা– হজ্ব– ৬৬। হযরত মুস্তাওরিদ বিন সাদ্দাত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন– হযরত নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, ‘পরকালের তুলনায় দুনিয়ায় শুধু ততটুকু যে, তোমাদের কেহ যদি তাঁর অঙ্গুলি (হাদিসের এক বর্ণনাকারী ইয়াহিয়া অনামিকা অঙ্গুলি ইশারা করলেন অর্থাৎ কেহ যদি তাঁর অনামিকা অঙ্গুলি) সমুদ্রে ডুবিয়ে বের করে আনে, অতপর সে দেখবে যে, সেই অঙ্গুলি কতটুকু পানি নিয়ে ফিরছে’। (মুসলিম শরীফ –৫১০১)।
লেখক : সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল