আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একটি শুধু নামই নয়, একটি আদর্শ। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ জনপ্রিয় রাজনীতিক। বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ছিলেন গরীব দুঃখি মেহনতি মানুষের পরম বন্ধু। তাঁর আলোয় আলোকিত হয়েছিল সমগ্র চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনীতি। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আমৃত্যু আনোয়ারা কর্ণফুলীর মানুষের পাশে নিজেকে উজাড় করে গেছেন। নীতি নৈতিকতা ছিল অনন্য সম্পদ। সাধারণ জনগণ ছিলেন তাঁর পরম আত্মার আত্মীয়, জয় করেছেন তাদের মন, ভালবাসা। বাঙালীর সম্মান, গৌরব, মূল্যবোধ ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে যে সকল রাজনীতিবিদ নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে একজন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। চট্টগ্রামে আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা ছিলেন তিনি, ৭৫ পরবর্তী আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে তাঁর অবদান অপরিসীম। একজন সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিক ও সমাজ সেবকের যেসব সমস্ত থাকা উচিত তার সবই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মধ্যে ছিল। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার পথে তিনি ছিলেন একজন মাঠের দক্ষকর্মী। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলা বিনির্মাণ ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বনেদী ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, একজন দেশ বরেণ্য শিল্পপতি, দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করার পরও নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছ্যন্দ্যবোধ করতেন না, দেশের মানুষকে ভালবাসতেন বিধায় তিনি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাঁর কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিরাট বিশাল। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। জীবন আমার ধন্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মত এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের আমার সুযোগ হয়েছে। তাঁর সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন বিশ্লেষণ করা, তাঁর মত এত বড় মাপের নেতা সম্পর্কে বলার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্ত তাঁর সাথে থেকে তাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি, মিশেছি সুখ দুঃখের সাথী হয়েছি, যা কিছু শিখেছি, দেখেছি তা আমাকে অভিভূত করেছে। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এই জননেতা সকল মানুষের বিপদে আপদে দরদী হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসতেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। যার ব্রত ছিল মানব কল্যাণ, আল্লাহ মানুষকে শ্রেষ্ঠ করেছেন মানব কল্যাণের জন্যই। তিনি আমৃত্যু তাই করেছেন। দলের দুঃসময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে তার সরব উপস্থিতি প্রতিটি নেতাকর্মীর মাঝে প্রাণ সঞ্চার করত, সময়ের প্রয়োজনে তিনি কখনো নির্লিপ্ত থাকেননি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির অভিভাবক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্মৃতি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নানা ঝড়ঝাপ্টার মাঝেও দলীয় আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল, দলীয় নেতা কর্মীদের নিকট হয়ে উঠেছিলেন বড় অবলম্বন। কেবল রাজনীতিই নয়, ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি। আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইনজীবী এবং জমিদার। তাঁর মাতার নাম খোরশেদা বেগম। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর উপজেলার মরহুম আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নুর নাহার জামান এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঐ বছরই ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট কাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। ওখান থেকে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি মূল সংগঠন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর পাথরঘাটাস্থ’ জুপিটার হাউজ থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকান্ড পরিচালিত হত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইকোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি ৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী।
স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরবর্তীতে দলের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। কেবল রাজনীতিই নয়, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দু’দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশ সমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তি জীবনে ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি পারিবারিক ও সমাজ জীবনেও আচার-আচরণ ছিল আলোকিত মানুষের। সামাজিক ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল রাজনীতির উর্ধ্বে এবং রাজনৈতিক ভেদাভেদের পরিনীতির উপরে। তাঁর ব্রত ছিল মূলত মানবতাবোধে উদ্দীপ্ত। তাঁর কাছে রাজনীতি ছিল বৃহত্তর মানব কল্যাণের মাধ্যম। মমত্ববোধ, মৈত্রী ও সমঝোতার অন্বেষণে তার প্রয়াস ছিল অক্লান্ত। সাংঘর্ষিক ও সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল দৃঢ় অথচ নম্র ও শান্ত। তিনি বনেদী ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ও দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি হয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে সাধারণ মানুষের রাজনীতিতে আমৃত্যু সম্পৃক্ত ছিলেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, তবুও তিনি আমাদের অন্তরে চির জাগ্রত। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, তাঁর স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও লালিত মূল্যবোধ। তাঁর আদর্শকে অন্তরে ধারণ করে প্রতিনিয়ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদেরকে পথ চলতে হবে। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মত ত্যাগী নেতার আজ বড়ই প্রয়োজন। তিনি সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে গেছেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সঞ্চয় ছিল সাধারণ মানুষের ভালবাসা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোভ ও লালসার ঊর্ধ্বে থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে যে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন সংগ্রাম-আন্দোলনে, সে মানুষটি আজ তাঁর নিজ গ্রামে চির নিদ্রায় শায়িত। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু প্রমাণ করেছেন মানুষকে ভালবাসলে তাদের জন্য কাজ করলে মানুষ ভালবাসায় তার প্রতিদান দেয়। তাই তো মরেও বেঁচে আছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। চট্টগ্রাম তাঁর সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে মনিকোঠায়। মৃত্যুর আজ ৫ম বছর। তিনি আজ আরো দীপ্তময়, আরো বেশি জনপ্রিয়। কিছু কিছু প্রাণ আছে দৃশ্যত মরে গেলেও সৃজনশীল শক্তি ও কর্মযজ্ঞ তাকে অমরত্ব দান করে। পৃথিবী ও সভ্যতা তাঁদের দানে হয় সমৃদ্ধ তেমন একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জননেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবার নয়।
লেখক : সাবেক একান্ত সচিব, মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এম.পি