আক্রান্তদের ৯০ শতাংশের শরীরে এন্টিবডি

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৯ মে, ২০২১ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তদের প্রায় ৯০ শতাংশের শরীরে এন্টিবডি পাওয়া গেছে। এই এন্টিবডি গড়ে ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে আক্রান্তদের শরীরে। ‘চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। নমুনা পরীক্ষায় আরটিপিসিআর পজিটিভ হওয়া রোগীদের পাশাপাশি নেগেটিভ হওয়া রোগীদের নিয়েও এ গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, আরটিপিসিআর নেগেটিভ হওয়াদের মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশের শরীরে মিলেছে এন্টিবডির উপস্থিতি। গবেষকরা বলছেন, এই ২৬ শতাংশ যেকোনোভাবে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু নমুনা পরীক্ষায় করোনা ধরা পড়েনি। আরটিপিসিআর পজিটিভ ও নেগেটিভ মিলিয়ে গড়ে ৬৫ শতাংশের শরীরে এই এন্টিবডির অস্তিত্ব মিলেছে মর্মে গবেষণার তথ্যে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ও মেডিসিনের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. আব্দুর রব মাসুমের নেতৃত্বে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গবেষণা টিমে আরো ছিলেন একই হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান, সাউথ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগী এম এ কবির চৌধুরী, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সহকারী সার্জন ডা. অমি দেব ও এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ পুষ্টি কর্মকর্তা ডা. মোরতাহিনা রশিদ।
গতকাল শনিবার দুপুরে জেনারেল হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ও জেনারেল হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবীর ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি এতে সভাপতিত্ব করেন।
গবেষকরা জানিয়েছেন, করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গযুক্ত রোগীদের শরীরে কোভিড-১৯ বিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি এবং এর স্থায়িত্ব অনুসন্ধান করাই ছিল এ গবেষণার উদ্দেশ্য। পাশাপাশি রোগীদের আর্থসামাজিক অবস্থা, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার সময় তাদের মধ্যে কি কি উপসর্গ বিদ্যমান ছিল এবং কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পরও কি কি দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা থাকছে, এসব নির্ণয় করাও এ গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য।
গত বছরের অক্টোবর মাসে শুরু হয়ে গত এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের মোট ১ হাজার ৫৩০ জনের শরীরের এন্টিবডি টেস্ট করা হয়। এর মধ্যে আরটিপিসিআর পজিটিভ ৯৪১ জন এবং নেগেটিভ ৫৮৯ জন।
গবেষকরা জানান, আরটিপিসিআর পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ ও নেগেটিভ হওয়া মিলে ৬৫ শতাংশের শরীরে এন্টিবডি পাওয়া গেছে। তবে পজিটিভ হয়ে সুস্থ হওয়ার পর অনেকের শরীরে এন্টিবডি ছিল না। পজিটিভ হওয়া ৯৪১ জনের মধ্যে ১০৭ জন এবং নেগেটিভ হওয়া ৫৮৯ জনের মধ্যে ৪৩৬ জনের শরীরে এন্টিবডি পাওয়া যায়নি। গবেষণায় পুরুষের অংশগ্রহণ ছিল ৭৬ শতাংশ। বাকিরা ছিলেন নারী।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের ৯২ শতাংশের জ্বর ও ৬৩ শতাংশের কাশি ছিল। ঘ্রাণশক্তি লোপ পায় ৫২ শতাংশের। এছাড়া গলাব্যথা, মাথাব্যথা, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ ছিল। আক্রান্তদের ১৫ শতাংশের ডায়াবেটিস, ২৩ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, ৯ শতাংশের শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা এবং হৃদরোগ জটিলতা ছিল।
গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পরে প্রায় ৫৭ শতাংশের কোনো না কোনো উপসর্গ দীর্ঘদিন যাবৎ বিদ্যমান ছিল। এর মধ্যে শারীরিক দুর্বলতা, ব্যথা, দুশ্চিন্তা, অবসাদ, কাশি, চুল পড়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ উল্লেখযোগ্য। এস আলম গ্রুপ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ গবেষণা কার্যক্রমে আর্থিক সহযোগিতা দেয়।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া ডা. আব্দুর রব মাসুম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছি। কোভিড-১৯-কে আরো বিষদভাবে জানার লক্ষ্যে রোগীদের লক্ষণ, সেরে ওঠার পর দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এবং এন্টিবডির উপস্থিতি নিয়ে এ গবেষণা, যা সময়োপযোগী ও জরুরি।
তিনি বলেন, গবেষণায় আমরা আরটিপিসিআর নেগেটিভ হওয়াদের মাঝে ২৬ শতাংশের শরীরে এন্টিবডির অস্তিত্ব পেয়েছি। অর্থাৎ এই ২৬ শতাংশ আরটিপিসিআর টেস্টে নেগেটিভ হলেও তারা যেকোনোভাবে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। কারণ, করোনায় আক্রান্ত না হলে তাদের শরীরে এন্টিবডি গড়ে ওঠার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। মোট কথা, তারা আক্রান্ত হলেও নমুনা পরীক্ষায় তাদের শরীরে করোনা ধরা পড়েনি।
ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, এই গবেষণার অন্যতম সাফল্য হলো, আক্রান্ত রোগীদের একটি বৃহৎ অংশকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের সরাসরি ইন্টারভিউ ও পরীক্ষার মাধ্যমে তথ্যগুলো সংগৃহীত হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল সরকারের চলমান কোভিড-১৯ টিকা কর্মসূচিকে আরো গ্রহণযোগ্য ও গতিশীল করবে।
ডা. এম এ কবির চৌধুরী বলেন, গবেষণায় উঠে এসেছে, ৬ মাসের অধিক সময় পর্যন্ত আরটিপিসিআর পজিটিভ রোগীদের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি থাকছে। সর্বোচ্চ ৯ মাস পর্যন্ত এন্টিবডির স্থায়িত্ব মিলেছে। এ সকল তথ্য আরো বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক জার্নালে উপস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি, যা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত গবেষণায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে সমুন্নত করবে।
গবেষণাকর্মের সমন্বয়ক ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান বলেন, আমাদের জানামতে জেলা পর্যায়ের কোনো হাসপাতালে নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণার এটিই প্রথম উদাহরণ। আশা করি, আমাদের এই উদ্যোগ চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত গবেষণাকর্মকে উৎসাহিত করবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধশিবির ক্যাডার কফিল গ্রেপ্তার