উৎসবমুখর পরিবেশে গতকাল উদযাপিত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। এ উপলক্ষে বৌদ্ধ বিহারগুলোতে নামে ভক্তের ঢল। দিনভর ধর্মীয় বিভিন্ন আচারের পাশাপাশি সন্ধ্যায় ছিল ফানুস উড়ানোর উৎসব। অহিংসা আর মঙ্গলের বারতা ছড়িয়ে ফানুসের আলোয় ঝলমলে হয়ে ওঠে রাতের আকাশ।
প্রবারণা উৎসব উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় নগরীর ডিসি হিল সংলগ্ন বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে মঞ্চ থেকে শত শত ফানুস উড়ানো হয়। পুরো আকাশ ভরে যায় রঙিন ফানুসে। সম্মিলিত প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন পরিষদের ব্যানারে বৌদ্ধ মন্দির চত্বরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এবার নানা থিমের বৈচিত্র্যময় নকশার ফানুস উড়েছে আকাশে। এরমধ্যে নজর কেড়েছে দৈত্যাকার হাতির আকাশে উড়া। এছাড়া অক্টোপাসও উড়েছে। অন্যদিকে তিন তলা ফানুস, চৌকোনা ফানুস। ফানুসে লেখা বুদ্ধের অমর বাণী, ছবি। কোনোটাতে আবার বৌদ্ধ যুব সংগঠনের নাম। উৎসবকে কেন্দ্র করে গতকাল বিকেল থেকে নন্দনকানন চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ মন্দির মোড়, ডিসি হিল মোড়ে প্রচুর মানুষ ভিড় করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. জীনবোধি ভিক্ষু বলেন, আড়াই হাজার বছর আগে সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভের পরীক্ষায় তার চুল কেটে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রতিবছর চট্টগ্রামের নন্দনকানন বৌদ্ধমন্দির থেকে ওড়ানো ফানুসে বিশ্বশান্তি কামনা, অসামপ্রদায়িকতা, সমপ্রীতি এবং দেশ–বিদেশের সর্বসামপ্রতিক পরিস্থিতি ও ঘটনাবলী নিয়ে বার্তা উল্লেখ করা হয়। এবারের ফানুসে অহিংসা ও মঙ্গলবারতা নানা বাণী তুলে ধরা হয়েছে। রং–বেরংয়ের ফানুস আনন্দ–উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে আকাশে উড়িয়েছেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।
নগরীর রাজাপুর লেইনের বাসিন্দা ইমা বড়ুয়া বলেন, প্রতিবছরের মতো বহুমাত্রিকতার মাধ্যমে এবারের প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন হচ্ছে। আমাদের ধর্মীয় আচার যেটা আছে, সেটা তো দিনভর হয়েছে। সন্ধ্যার পর আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই মিলে–মিশে প্রবারণা উৎসব পালন করছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিবছরই এভাবে সার্বজনীনতার প্রকাশ ঘটাই। মৈত্রী, সমপ্রীতি, অসামপ্রদায়িকতা এ উৎসবের মূলমন্ত্র করে নিয়েছি আমরা।
অন্যদিকে নগরীর নব পণ্ডিত বিহারেও প্রবারণা উৎসব ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নব পণ্ডিত বিহারের বিহারাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. উপানন্দ মহাথেরোর সভাপতিত্বে এবং উপাধ্যক্ষ রতনানন্দ থেরো’র সঞ্চলনায় উদ্বোধক ছিলেন বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সিনিয়র সহ–সভাপতি দেবপ্রিয় বড়ুয়া। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন লায়ন মৃদুল বড়ুয়া চৌধুরী, মুখ্য আলোচক ছিলেন প্রফেসর ড. সুব্রত বরণ বড়ুয়া, বিশেষ অতিথি ছিলেন ট্রাস্টি রুবেল বড়ুয়া হৃদয়, মি. কমলেন্দু বিকাশ বড়ুয়া, বিনয় ভূষণ বড়ুয়া, প্রকৌশলী পরিতোষ কুমার বড়ুয়া, অঞ্চল কুমার তালুকদার, অনিমেষ তালুকদার, শুভাশীষ বড়ুয়া সিন্টু, লায়ন কেমি বড়ুয়া মুক্তা, রোটারিয়ান অমরেশ বড়ুয়া চৌধুরী প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ২৮জন বুদ্ধ কীর্তনীয়াকে সম্মাননা প্রদান করা হয় এবং শ্রেষ্ট উপাসক–উপাসিকা সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ বছরের শ্রেষ্ট উপাসক বাবু প্রদীপ বড়ুয়া ও শ্রেষ্ঠ উপাসিকা শ্রীমতি সুচরিতা বড়ুয়া। সকাল থেকে দিনব্যাপী আলোচনা ও পূজা–বন্দনা শেষে সন্ধ্যায় বিশ্বেও শান্তি কামনায় আকাশ প্রদীপ ফানুস উড়ানো হয়। এছাড়া পাথরঘাটা জেতবন শান্তিকুঞ্জ বিহার, ইপিজেড সর্বজনীন বৌদ্ধবিহার ও মৈত্রী বনবিহার, চান্দগাঁও সর্বজনীন বৌদ্ধবিহার, মোগলটুলী শাক্যমুনি বৌদ্ধবিহার, বন্দর বৌদ্ধবিহারসহ প্রায় প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে সকাল থেকেই নানা আয়োজন করা হয়েছে।
এদিকে বাঁশখালী প্রতিনিধি জানায়, প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন উপলক্ষে বাঁশখালীর বৌদ্ধ বিহারে গুলোতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। সকালে বুদ্ধ পুজা, সীবলী পুজা, পপঞ্চশীল, অষ্টশীল গ্রহণ করা হয় এবং সমবেত প্রার্থনা, আকাশ প্রদীপ (ফানুস) উত্তোলন করা হয়। প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকে ধর্মীয় কার্যাদি সন্ধ্যায় আকাশ প্রদীপ ফানুস উত্তোলন করা হয়। এদিকে প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ জামশেদুল আলম, ওসি সাইফুল ইসলামসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বাঁশখালীর বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে পরিদর্শণ করেন এবং প্রবারণার শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
আমাদের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানিয়েছে, প্রবারণা পূর্ণিমাকে সামনে রেখে খাগড়াছড়ির বৌদ্ধ বিহার গুলো সাজানো হয়েছে নানান রঙে। এসময় দেশ জাতি ও বিশ্ব শান্তি কামনায় সোমবার সকাল থেকে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধ পতকা উদ্বোধন, প্রদীপ প্রজ্জলন, ফুলপুজা, বুদ্ধ পুজা, পঞ্চশীলপ্রার্থনা, বুদ্ধমুর্তিদান, সংঘদান, অষ্ট পরিস্কার দান ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পিন্ডদানসহ নানাবিধ দান করে ভক্তরা। খাগড়াছড়ি জেলা সদরের য়ংড বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ক্ষেমাসারা থেরো জানান, প্রবারণার অর্থ সকলের কায়িক মন বাসনা পূরণের জন্য, কারো যদি ভূল–ক্রুটি, একে অপরের ক্ষমা, মৈত্রী নিয়ে থাকাটাই হচ্ছে প্রবারণা।