আই সি ইউ: লিটনের ভিন্নব্যঞ্জনার ছবি

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ

নিঃসঙ্গতা কিংবা একাকিত্বের সমস্যা বিশ্বজনীন। এসমস্যা এতটাই ভয়ঙ্কর, সাধারণত একে আমরা মানুষের পরিণত বয়সের সমস্যা মনে করলেও যে কোনো বয়সের একজন মানুষ এ সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। সারা বিশ্বের চরম ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় নিঃসঙ্গতা জীবন বিধ্বংসী এক উপসর্গে পরিণত। তথাকথিত সভ্যতার প্রায় চূড়ান্ত প্রান্তসীমায় পৌঁছে মানুষ এখন সেসভ্যতার ক্রীড়ানক হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, অসহিষ্ণুতা, পরশ্রীকাতরতা এসবই এখন মানুষের বৈশিষ্ট্য। যেন সহজাত বৈশিষ্ট্য। দিগবলয়হীন মহাশূন্যে যেন আমরা, এই ক্রমক্ষয়িষ্ণু গ্রহটির অধিবাসীরা, প্রত্যেকেই একেকটা ক্যাপসুলের মধ্যে বসবাস করছি। কারো প্রতি কারো যেন এতটুকু ভ্রুক্ষেপমাত্রও নেই।

লিটন করের ১১ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ICU (I See you) দেখে কথাগুলি মনে পড়ছিল। ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় যখন নগরীর একটি সিনেপ্লেক্সে ছবিটি দেখছিলাম তখন প্রেক্ষাগৃহের অনেক দর্শকের মধ্যে থেকেও নিজেকে নিঃসঙ্গ একাকী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এক মহাজাগতিক হিমশীতল নৈঃশব্দ্যে পরিভ্রমণ

করছিলাম একা। ১১ মিনিটের ছোট ছবিটা যে অনুভূতি জারিত করেছিল তা যেন ১১ বছরের বা তারও চেয়ে আরও অনেক বেশি সময় ধরে ভাববার। ছবিতে একটাই মাত্র চরিত্র। একজন তরুণী একটা বাড়িতে হয়তো সে একা থাকে। কিংবা অনেকের সঙ্গে, বা আর কারো সঙ্গে থাকলেও একা। এগার মিনিটে তার

একটা রাতের দুঃস্বপ্নের চিত্র আমরা দেখি। কিংবা সেটা দুঃস্বপ্ন নয় মোটেই। হয়তো সেটা বাস্তব। হয়তো সেটা তার নিশাচরণচেতনে কিংবা অবচেতনে। আমরা সবাই যেন চাবি দেওয়া পুতুলের মতো নির্দিষ্ট এক কক্ষপথে ঘুরে মরছি প্রতিনিয়ত।

লিটন চারুকলার ছাত্র (পড়েছেন চট্টগ্রাম চারুকলায়)। অন্তর্গত শিল্পসত্তায় তিনি বিমূর্ততাকে মূর্ত করে তুলেছেন যেমন, তেমনি যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে বিমূর্ত। ক্যামেরাকে তুলি করে সেটের ক্যানভাসে তিনি ছবি এঁকেছেন। খেলেছেন রঙের হোলি সুচারু পরিমিতিতে। ছবিতে সংলাপ নেই। সংগীত আছে যথাযথ। আবহ

শব্দ পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে সহযোগী ভূমিকা রাখলেও কখনও কখনও কি একটু উচ্চকিত হয়ে উঠেছে? ভৌতিক পরিবেশ তো মন্ত্রস্বরেও আসে।

ছবির যে আখ্যান সেটা এক রাতের হলেও বিভিন্ন রাতেরও হতে পারে। ছবিটি চিত্রায়িত হয়েছে কোভিড চলাকালে। ফলে এই অতিমারী বা মহামারীর সেই

দমবদ্ধ পরিবেশের নিঃসঙ্গ অসহায় সময়ের চিত্র ছবিতে আমরা যদিও দেখি, তবে সে চিত্র আমাদের এই বিপর্যস্ত জীবনের যে কোনো এক রাতের দুঃস্বপ্নেরও হতে পারে। এক রাতের দুঃসহ অভিজ্ঞতার চিত্রে অনুষঙ্গ হয়ে আসে বৈশ্বিক সম্প্রসারণবাদী রাজনীতির নাগপাশ, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও নিষ্পেশন, বাকস্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ নানা সিম্বল ও মোটিফের আশ্রয়ে।

আইসিইউ’র মূল চরিত্র শুভশ্রীর ভূমিকায় যথাযথ অভিনয় সুষমা সরকার। সহযোগী চরিত্রে জাকিয়া বারী মমও ভালো। ছবির চিত্রনাট্য এবং চিত্রগ্রহণ দুটোই পরিচালক লিটন করের করা। প্রযোজনাও তার। লিটন চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। প্রোডাকশন ডিজাইন, সহযোগী পরিচালনা, পোস্টার

ডিজাইনের কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রে। ১১ মিনিটের ছোট এই ছবিতে লিটনের সঙ্গে কাজ করেছেন অনেকে। সংগীত নির্মাণে রাশেদ শরীফ শোয়েব, সাউন্ড ডিজাইনে সজীব রঞ্জন বিশ্বাস ও রাজেশ সাহা, সম্পাদনা ও কালার গ্রেডিং এ শরিফ আহমেদ, শিল্প নির্দেশনায় গৌতম কর এবং উইন্ড স্টোরিজের ব্যানারে ছবি নির্বাহী প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন তানভীর হোসাইন।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আইসিইউ ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত, প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হয়েছে। পরিচালকসহ সকল কলাকুশলী এই কৃতিত্বের অংশীদার। আমরা চলচ্চিত্রকার লিটনের অবিরাম অভিযাত্রা কামনা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ মিনারের জয়