আইপিএল নিয়ে চলছে জুয়া

ঘটছে খুন, আত্মহত্যা

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৯ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বাজির ঘোড়া ছুটছে জোর কদমে। আইপিএল- এর মৌসুমে বাজির ঘোড়া লাগামহীন হয়ে পড়ে। সামপ্রতিক সময়ের ক্রিকেট ও ফুটবল অঙ্গনে ‘স্পট ফিক্সিং’ আর ‘লাগবা বাজি’ বহুল আলোচিত দুটি শব্দ। আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের উপর নজরদারি বাড়ানো কিংবা স্পট ফিক্সিং প্রতিরোধে আইসিসি বা ফিফা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সব প্রযুক্তির শরণাপন্ন হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জুয়াড়িদের কিছুতেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। তাদের সকল প্রচেষ্টার ফাঁক গলে খেলা নিয়ে জুয়া চলছে এখন গলি থেকে রাজপথ সর্বত্রই। আধুনিক ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত অথচ জনপ্রিয় সংস্করণ টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট। বিশ্বকাপ, আইপিএল, বিপিএল, যা-ই হোক না কেন জুয়ার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে গোটা দেশ। চলতি আইপিএল টুর্নামেন্টও বাদ যায় কেন ? জুয়াড়িরা বসে নেই। কোন টিম জিতবে তাতো আছেই, কে কত উইকেট পাবে, জিতলে রানে জিতবে না উইকেটে, নির্দিষ্ট একটি ওভারে রান কত হবে, ওভারে হিট উইকেট হবে কিনা, কোন বোলার নো বল করে কিনা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে জুয়া চলছে সর্বত্র। এই জুয়া খেলা নিয়ে অধিকাংশই হচ্ছে সর্বস্বান্ত, কেউ হচ্ছে খুন, কেউ করছে আত্মহত্যা।
ক্রিকেটই এখন দেশের মানুষের কাছে ধ্যান-জ্ঞান। বাংলাদেশের খেলা হলেতো কথা-ই নেই, বিপিএলও টানে মানুষকে। তবে আইপিএল হয়ে উঠেছে জুয়াড়িদের কাছে সবচেয়ে লোভনীয়। প্রিয় টিমের খেলার দিন মানুষ তাকিয়ে থাকে টিভি স্ক্রিনের দিকে। খেলার দিন শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও খবর রাখে তারা কোন টিম কেমন খেলছে। এক ধরনের অসাধু চক্র মানুষের আবেগ-ভালবাসাকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই হাজার হাজার টাকার ফলাফল বাজি, ওভার বাজি, রানবাজি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলছে। এ জুয়াবাজির ফাঁদে পড়ে অনেকেই হয়ে যাচ্ছেন নিঃস্ব। টাকার লেনদেন নিয়ে অনেক সময়ই ঘটে নানা ধরনের বিপত্তির ঘটনা। হাটহাজারী থানার চিকনদন্ডী ইউনিয়নের আমান বাজারে চায়ের দোকানে গত ৫ এপ্রিল মঙ্গলবার আইপিএলের দল পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় ফারুক ও ফয়সালের মধ্যে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে ফয়সাল ১৫-২০ জন সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে ফারুককে বেধড়ক পিটিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় তার বোন জেসমিন ভাইকে বাঁচাতে ছুটে এলে তাকেও পেটানো হয়। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ফারুক ও তার বোন জেসমিনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক ফারুককে মৃত ঘোষণা করেন। বোন জেসমিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পাড়া-মহল্লার অলিগলি, বাজার থেকে শুরু করে নগরীর অভিজাত হোটেলগুলোতেও চলছে আইপিএল নিয়ে জুয়া। চায়ের দোকান, রেস্তোরাঁ, সেলুন, রিকশা গ্যারেজ ইত্যাদি কেন্দ্রিক ক্রিকেট জুয়ার আসর বসছে প্রতিদিন। এ সব আসরে যোগ দেওয়া বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ এবং বিভিন্ন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁরা জুয়ার আসরে এসে প্রতিদিনই নিঃস্ব হচ্ছেন। সামপ্রতিক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম আলোচিত বিষয় ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ ঘিরে স্পট ফিক্সিং এবং বাজি। আন্তর্জাতিক বা ঘরোয়া বিভিন্ন ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচকে ঘিরে বাজিকরদের চলে দর কষাকষি। দুর্বল টিমের সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের খেলা থাকলে সেক্ষেত্রে দেয়া হয় লোভনীয় সব অফার। চার ছয়ের খেলা টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট। আইপিএল টুর্নামেন্টে প্রায় সমশক্তির দল হওয়ায় বাজির বাজার সরগরম। জুয়াড়িরা মনে করছে ম্যাচে যে কেউ জিততে পারে।
পরিসংখ্যান বলে, পাশের দেশ ভারত এবং পাকিস্তানে স্পট ফিক্সিংসহ বাজির প্রভাবটা অনেক বেশি। বিশ্বে পাঁচটি বাজিকর বা জুয়াড়ি অধ্যুষিত দেশের মধ্যে থাকবে এ দুই দেশের নাম। বিশ্লেষকদের মতে, আমাদের দেশে বাজিটা এসেছে এ দুই দেশ থেকেই। আর ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে। আন্তর্জাতিক পরিসরের বাজিকরদের আনাগোনা আমাদের দেশে তুলনামূলক কিছুটা কম হলেও ঘরোয়া বাজিকরদের বিচরণ ক্ষেত্রটা অনেক বেশি।
সরেজমিনে গতকাল শুক্রবার বিকেলে নগরীর গোয়ালপাড়া এবং ঘণ্টা খানেক পর হাজারীগলি গিয়ে আইপিএল নিয়ে রমরমা বাজির দৃশ্য চোখে পড়ে। কাছে ভিড়তেই দেখা যায় হাতবদল হচ্ছে টাকা। ফোনে রেট জেনে বাজি ধরছেন শাহজাহান (ছদ্মনাম) নামে একজন। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, বিরক্ত করবেন না তো, মেজাজ খারাপ আছে, মাত্রই টাকা হারালাম। ম্যাচে পাওয়ার প্লেতে কত রান হবে, ৫/১০ ওভারে কত রান হবে, টোটাল রান কত হবে, কোন প্লেয়ার বেশি রান করবে সব কিছুতেই চলে বাজি।
আইপিএলে বাজির নেশায় লাখ টাকা হারিয়ে এই জুয়া খেলার ফাঁদ থেকে বের হয়ে এসেছেন তন্ময় আহমেদ (ছদ্মনাম) নামের একজন। ক্রিকেটের এই সর্বনাশা জুয়া সম্পর্কে জানালেন, টিভিতে ক্রিকেট খেলা চলার সময় নগরীর পাড়া-মহল্লায় আড্ডায়, সেলুন, ফ্লেক্সিলোড কিংবা চায়ের দোকানে অনেক লোক জড়ো হয়ে নিজেদের মধ্যে খেলা নিয়েই আলোচনা করে। বাইরে থেকে কেউ দেখে মনে করবেন, তারা ক্রিকেট পাগল। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর বেশির ভাগই জুয়ার আসর। এ খেলায় ছাত্র, বেকার, ব্যবসায়ী সবাই জড়িত। ১০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে একপর্যায়ে চলে হাজার হাজার টাকার জুয়া। ব্যক্তিগত পর্যায়েও জুয়া হয়। আবার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জুয়ার কেনাবেচাও হয়। এ লোভেই নিঃস্ব হচ্ছে শত শত মানুষ। সুদে টাকা নিয়ে জুয়ায় নামার নজিরও আছে। কীভাবে এই জুয়া খেলা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকে এটাকে ‘ইস্টু’ খেলাও বলেন। প্রথম দিকে এই খেলা ছিল কোন দল জিতবে? এটার ওপর বাজি ধরতো সবাই। আস্তে আস্তে ওটার সঙ্গে শুরু হয় কোন খেলোয়াড় কত রান করবে? কত ওভারে কত রান হবে, পাওয়ার প্লেতে কত রান আসবে, এই ক্রিকেটার হাফ সেঞ্চুরি না কি সেঞ্চুরি করবে, মোট রান কত হবে, টসে কোন দল জিতবে?-এসব নিয়ে’। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যেমন কলকাতা-লক্ষ্ণৌ খেলার দর ধরা হয় সমান। অর্থাৎ এক হাজার টাকা জুয়ায় জিতলে দুই হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আবার মুম্বাই ইন্ডিয়ানস-হায়দ্রাবাদ খেলার দর হয় ১০:১৫। অর্থাৎ হায়দ্রাবাদের পক্ষে যারা এক হাজার টাকা বাজি ধরেছিলেন, জিতলে তারা আড়াই হাজার টাকা পাবেন। ভালো দলের সঙ্গে খারাপ দলের খেলা হলে দর কষাকষিটা হয় ভিন্নভাবে।
সরেজমিনে অনুসন্ধানের সময় প্রতিবেদকের আচরণে সন্দেহ করেন এক জুয়াড়ি। দৃষ্টি আড়াল করতে ৫০০ টাকাকে ৫ আর ১০০০ টাকাকে ১০ টাকা সংকেত হিসেবে পর্যায়ক্রমে জুয়ার অংক নির্ধারণ করেন। খেলা শেষে এজেন্ট তার সুবিধাজনক স্থান ও সময়ে পরাজিত জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা নিয়ে জয়ী জুয়াড়ির কাছে হস্তান্তর করেন। এজেন্টরা জয়ী জুয়াড়ির কাছ থেকে টাকা হস্তান্তরের বিনিময়ে কমিশন পান বলেও জানান তিনি।
ক্রিকেট নিয়ে জুয়া নতুন নয়। ২০১৪ সালে ঢাকায় ধরা পড়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জুয়াড়ি অতনু দত্ত। তাকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানতে পারে, ওই জুয়ার সঙ্গে আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ও নিরাপত্তা ইউনিটের কর্মকর্তা ধরম সিং যাদব জড়িত ছিলেন। চট্টগ্রামে এ জুয়া খেলায় সর্বস্বান্ত হয়ে হাজারীগলির এক ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া রেয়াজউদ্দিন বাজারের এক দোকান মালিকের সন্তান ছিনতাই করা কালে ধরা পড়ে লাভলেন মোড়ে।
সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন, দেশে চলছে ক্রিকেট নিয়ে বাজিকরদের বাজি (জুয়া) খেলা। অনেক ক্রিকেট জুয়াড়ি জুয়ার টাকা জোগাতে চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছাত্ররা বিপথগামী হচ্ছে। একইসঙ্গে জুয়ায় হার-জিতকে কেন্দ্র করে পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে। তবে সর্বনাশা এই খেলাটি বন্ধ করতে ইতোমধ্যে নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (বন্দর-গোয়েন্দা) একেএম মহিউদ্দিন সেলিম আজাদীকে বলেন, আইপিএল ম্যাচকে কেন্দ্র করে জুয়াড়িরা জুয়ায় যাতে না বসে সেজন্য নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা রয়েছে। নিয়মিত টহলও চলছে।
এ প্রসঙ্গে কোতোয়ালী থানার ওসি জাহিদুল কবির আজাদীকে বলেন, পাড়ায় পাড়ায় চলতে থাকা বাজি বা জুয়ার ব্যাপারে আমরা কিছু প্রমাণ পেয়েছি। তবে এলাকাবাসীকেও বিষয়টি নিয়ে আরো সচেতন হতে হবে। যদি কারও কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ থাকে তাহলে আমাদের জানালে অ্যাকশন নেব এবং অভিযুক্তকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসব দেশে টিকা নিশ্চিতে সহায়তার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা